ইসলামী পরিভাষায় যে সমস্ত গ্রন্থ আল্লাহতায়ালা মানবজাতির হেদায়াতের জন্য দিকনির্দেশনা স্বরূপ নাযিল করেছেন তাকে আসমানি গ্রন্থ বলে। আসমানি গ্রন্থ শুধুমাত্র মহান আল্লাহপাকের বাণী সমষ্টি। আল্লাহতায়ালা জিবরাইল (আঃ) ফেরেশতার মাধ্যমে তাঁর বাণীসমূহ নবী-রাসুল (আঃ) গণের নিকট প্রেরণ করেছেন। আর নবী-রাসুল (আঃ) গণ তা সাধারণ মানুষের কাছে যুগে যুগে পৌঁছে দিয়েছেন। আর যখন এমন সময় এসেছে কোন নবী বা রাসুল (আঃ) হায়াতে নেই দুনিয়াতে, তখন সিলসিলার অলি-আল্লাহ (রঃ) গণ মানুষের কাছে আল্লাহর বাণী প্রচার করেছেন। মহান আল্লাহতায়ালার এভাবে পবিত্র বাণী মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্বকে রিসালাত বলে।
মহান আল্লাহ সর্বমোট ১০৪ টি আসমানি গ্রন্থ নাযিল করেছেন। এর মধ্যে ৪ টি বড় এবং ১০০ টি ছোট গ্রন্থ। ছোট গ্রন্থগুলোকে সহিফা বলা হয়। যাদের উপর আসমানি গ্রন্থ নাযিল হয়েছে তাদের রাসুল (আঃ) বলে আর যাদের উপর কোন আসমানি গ্রন্থ নাযিল হয়নি কিন্তু পূর্ববর্তী ধর্মগ্রন্থের বাণী প্রচার করেছেন, তাদের নবী (আঃ) বলা হয়।
১০০ সহিফা চারজন রাসুল (আঃ) গণের উপর নাযিল হয়েছে। হযরত আদম (আঃ)-এর উপর ১০টি, হযরত শিস (আঃ)-এর উপর ৫০টি, হযরত ইব্রাহিম (আঃ)-এর উপর ১০টি এবং হযরত ইদ্রসি (আঃ)-এর উপর ৩০টি সহিফা নাযিল হয়েছে।
বড় চারটি আসমানি গ্রন্থ চারজন রাসুল (আঃ)-এর উপর নাযিল হয়েছে। হযরত মূসা (আঃ)-এর উপর তাওরাত, হযরত দাউদ (আঃ)-এর উপর যাবুর, হযরত ঈসা (আঃ)-এর উপর ইঞ্জিল এবং নবী-রাসুল (আঃ) গণেরও রাসুল হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর উপর নাযিল হয়েছে সর্বশেষ, সর্বশ্রেষ্ঠ ও সবচেয়ে মর্যাদাবান গ্রন্থ আল-কুরআন।
আসমানি গ্রন্থসমূহ সকল জ্ঞান-বিজ্ঞানের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য উৎস। এ সকল গ্রন্থে সৃষ্টিজগৎ, মানবসৃষ্টি, পরকাল ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে। সর্বোপরি মানুষ হেদায়েতের মাধ্যমে কিভাবে মুমিন বান্দায় পরিণত হবে তার সঠিক দিকনির্দেশনা আসমানি গ্রন্থসমূহে সুস্পষ্ট ভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। আসমানি গ্রন্থে বিশ্বাস স্থাপন ঈমানের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আসমানি গ্রন্থসমূহের মাধ্যমেই মানুষ মহান আল্লাহ, নবী-রাসুল (আঃ) গণ, ফেরেশতা (আঃ) গণ, পরকাল ইত্যাদি সম্পর্কে জানতে পেরেছে।
নবী করিম (সাঃ) ৪০ বছর বয়সে সৌদি আরবের মক্কার হেরা গুহায় ধ্যানমগ্ন থাকা অবস্থায় সর্বপ্রথম সূরা আলাকের প্রথম ৫টি আয়াত নাযিল হয়। এভাবে পবিত্র কুরআন নাযিল হওয়া শুরু হয়। অতঃপর রাসুল (সাঃ)- এর নবুয়তের ২৩ বছরে অল্প অল্প করে প্রয়োজন মাফিক সম্পুর্ণ কুরআন নাযিল হয়। আল-কুরআনে ৩০টি খন্ড রয়েছে। প্রতিটি খন্ডকে এক একটি পারা বলে। এর সূরা সংখ্যা সর্বমোট ১১৪ টি, যার মধ্যে মক্কায় নাযিল হয়েছে ৮৬ টি এবং মদীনায় নাযিল হয়েছে ২৮ টি। আল-কুরআন “লাওহে মাহফুজ” বা সংরক্ষিত ফলকে লিপিবদ্ধ আছে। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন,
بَل هُوَ قُرءانٌ مَجيد ٌ فى لَوحٍ مَحفوظٌٍ
অর্থ: বরং তা পূর্ণ মর্যাদা সম্পন্ন কুরআন, লাওহে মাহফুজের মধ্যে লিপিবদ্ধ। (সূরা আল-বুরূজ, আয়াত- ২১,২২)
মহান আল্লাহ সর্বপ্রথম কদরের রাতে গোটা কুরআন মজিদ লাওহে মাহফুজ থেকে “বায়তুল ইযযাত” নামক স্থানে নাযিল করেন। বায়তুল ইযযাত হলো প্রথম আসমানের একটি বিশেষ স্থান। এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেছেন,
ٌ بِسمِ اللَّهِ الرَّحمٰنِ الرَّحيمِ إِنّا أَنزَلنٰهُ فى لَيلَةِ القَدر
অর্থ: নিশ্চয় আমি সেটা (কুরআন) কদরের রাতে অবতীর্ণ করেছি (লাওহে মাহফুজ থেকে বায়তুল ইযযাতে)। (সূরা আল-কদর, আয়াত-১)
মহান আল্লাহ আরো বলেছেন,
إِنّا نَحنُ نَزَّلنَا الذِّكرَ وَإِنّا لَهُ لَحٰفِظونٌَ
অর্থ: নিশ্চয় আমি অবতীর্ণ করেছি কুরআন এবং নিশ্চয় আমি নিজেই এর সংরক্ষক। (সূরা হিজর, আয়াত-৯)
পবিত্র কুরআন মজিদ অবিকৃত এবং এটা নাযিল হবার পর সকল আসমানি গ্রন্থ স্থগিত হয়ে যায়। এর অর্থ এই যে, রাসুলেপাক (সাঃ)-এর পরে আর কোন নবী-রাসুল (আঃ) গণ কোন আসমানি গ্রন্থ নিয়ে আসবেন না মানুষের হেদায়েতের জন্য আর পবিত্র কুরআনই শেষ আসমানি গ্রন্থ। এ মহাগ্রন্থ কুরআনে রয়েছে রাসুলেপাক (সাঃ)-এর পূববর্তী অসংখ্য নবী-রাসুল (আঃ) গণ এবং তাদের সম্প্রদায়ের ইতিহাস, মহানবী (সাঃ) পৃথিবীতে অবস্থান কালে বিভিন্ন স্থান-কাল-পাত্রের ঘটনার বর্ণনা; সর্বোপরি এ সব প্রকাশের মধ্য দিয়ে মহান আল্লাহ কর্তৃক তাঁর প্রিয় হাবিব মুহাম্মদ (সাঃ)-এর নবুয়ত প্রাপ্তির পর পবিত্র কালেমা কেয়ামত পর্যন্ত কিভাবে মানুষ গ্রহণ করবে, আঁকড়ে থাকবে এবং অলি-আল্লাহ (রঃ) গণ ইসলাম প্রতিষ্ঠিত রাখবেন তার দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। ইসলাম প্রচার ও প্রতিষ্ঠার দিকনির্দেশনাই পূর্ববতী সকল পবিত্র আসমানি গ্রন্থে বর্ণনা করা হয়েছে যার যবনিকা টানা হয় আল-কুরআনের মাধ্যমে। পবিত্র কুরআন মজিদের মেয়াদ কেয়ামত পর্যন্ত যা মানুষের হেদায়েতের দিকনির্দেশনা ।
মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেছেন,
وَيَومَ نَبعَثُ فى كُلِّ أُمَّةٍ شَهيدًا عَلَيهِم مِن أَنفُسِهِم وَجِئنا بِكَ شَهيدًا عَلىٰ هٰؤُلاءِ وَنَزَّلنا عَلَيكَ الكِتٰبَ تِبيٰنًا لِكُلِّ شَيءٍ وَهُدًى وَرَحمَةً وَبُشرىٰ لِلمُسلِمين َ
অর্থ: এবং যে দিন আমি প্রত্যেক সম্প্রদায়ের মধ্যে একজন সাক্ষী তাদের মধ্য থেকে উঠাবো, যে তাদেরই বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে এবং হে মাহবুব! আপনাকে সবার উপর সাক্ষী বানিয়ে উপস্থিত করবো আর আমি আপনার উপর এ কুরআন অবতীর্ণ করেছি, যা প্রত্যেক বস্তুর সুস্পষ্ট বিবরণ, হেদাআত, দয়া ও সুসংবাদ মুসলমানদের জন্য। (সূরা আন-নাহল, আয়াত-৮৯)
কুরআনের সত্যতা সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন,
وَرَبِّ السَّماءِ وَالأَرضِ إِنَّهُ لَحَقٌّ مِثلَ ما أَنَّكُم تَنطِقوََ
অর্থ: সুতরাং আসমান ও যমীনের রবের শপথ! নিশ্চয় এ কুরআন সত্য, যেমনি ভাবে জিহŸা দ্বারা তোমরা কথা বলছো। (সূরা আযযা-রিয়াত, আয়াত-২৩)। এখানে মহান আল্লাহ নিজের শপথ করে কুরআনের সত্যতা বর্ণনা করেছেন এবং সূরা ইয়াসীন এ কুরআনের শপথ করে রাসুলেপাক (সাঃ)-এর সত্যতা বর্ণনা করেছেন,
القُرءانِ الحَكي َ إِنَّكَ لَمِنَ المُرسَلينَ َ عَلىٰ صِرٰطٍ مُستَقي ٌ
অর্থ: ২. হিকমতময় কুরআনের শপথ, ৩. নিশ্চয় আপনি প্রেরিত- ৪. সরল পথের উপর। (সূরা ইয়াসীন, আয়াত-২,৩,৪)
পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ বলেছেন,
وَالسَّماءِ ذاتِ الرَّجعِ َ الأَرضِ ذاتِ الصَّدعِ َ إِنَّهُ لَقٌَ
অর্থ: ১১.আসমানের শপথ, যা থেকে বৃষ্টি নামে, ১২. এবং যমীনের শপথ, যা বিদীর্ণ হয়, ১৩. নিশ্চয় কুরআন একটা মীমাংসাকারী বাণী। (সূরা আত্বত্বোয়া-রিক্ব , আয়াত-১১,১২,১৩)
আর কুরআনের ধারক মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর সত্যতা কুরআনের শপথ করে বর্ণনা করেছেন মহান আল্লাহ। উপরোক্ত আয়াতগুলোয় স্পষ্টরূপে প্রমাণ হয় যে, হুজুরেপাক (সাঃ) আল্লাহর কুরআন অপেক্ষা বেশী গুরুত্বপূর্ণ। আরো পরিষ্কার করে বলা যায়, আল্লাহর কোন সৃষ্টিই মহানবী (সাঃ)-এর চেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ নয়। বরং মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয় হাবিব রাসুল (সাঃ)-এর শান, মান, মর্যাদা চূড়ান্ত প্রকাশের জন্য সৃষ্টি করেছেন মানবজাতি, ফেরেশতা (আঃ) গণ, পূর্ববর্তী নবী-রাসুল (আঃ) গণ, সাত আসমান-যমীন, পরকাল, সকল আসমানি গ্রন্থসহ আর সব সৃষ্টি।
পবিত্র কুরআন মজিদে আল্লাহ বলেছেন,
مِنَ اللَّهِ نورٌ وَكِتٰبٌ مُبينٌ َ يَهدى بِهِ اللَّهُ مَنِ اتَّبَعَ رِضوٰنَهُ سُبُلَ السَّلٰمِ وَيُخرِجُهُم مِنَ الظُّلُمٰتِ إِلَى النّورِ بِإِذنِهِ وَيَهديهِم إِلىٰ صِرٰطٍ مُستَقيمٍ َ
অর্থ: ১৫. নিশ্চয় তোমাদের নিকট আল্লাহর পক্ষ থেকে একটা “নূর” এসেছে এবং স্পষ্ট কিতাব, ১৬. আল্লাহ তা দ্বারা সরল পথ প্রদর্শন করেন তাকেই যে আল্লাহর সন্তুষ্টি মোতাবেক চলে নিরাপত্তার পথে এবং তাদেরকে অন্ধকার রাশি থেকে আলোর দিকে নিয়ে যান স্বীয় নির্দেশে এবং তাদেরকে সরল পথ দেখান। (সূরা মায়েদা, আয়াত-১৫,১৬)
অর্থাৎ মহান আল্লাহ কেয়ামত পর্যন্ত মানুষকে সরল পথে আনয়ণের লক্ষ্যে প্রেরণ করেছেন রাসুল (সাঃ) কে হাজির-নাজির নূররূপে। মহান রব নবী করিম (সাঃ) কে নবুয়ত দেন ৪০ বছর বয়সে এবং তারপর দীর্ঘ ২৩ বছর ধরে তাঁর মাধ্যমে ইসলাম প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করেন এ যমীনে। রাসুল (সাঃ) বিদায় হজের ভাষণে বলেছেন, রেখে গেলাম এই পবিত্র কুরআন এবং আহলে বায়আত, আহলে বায়আত, আহলে বায়আত; যতদিন তোমরা এ দুটি আঁকড়ে থাকবে ততদিন পথভ্রষ্ট হবে না। (বুখারি)