ঈমান শব্দের অর্থ বিশ্বাস করা, আস্থা স্থাপন, স্বীকৃতি দেয়া, মেনে নেয়া, নির্ভর করা ইত্যাদি। ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলোতে বিশ্বাস স্থাপন করাকে ঈমান বলা হয়। ইসলামী পরিভাষায় নির্ধারিত বিধি-বিধান অন্তরে বিশ্বাস করা, মুখে স্বীকার করা এবং তদানুযায়ী আমল করাকে ঈমান বলে। যে ব্যক্তি ঈমান আনে এবং আল্লাহ ও রাসুলেপাক (সাঃ)-এর আনুগত্য করে তাকে মুমিন মুসলমান বলা হয়। ঈমানের পরিচয় সম্পর্কে রাসুল (সাঃ) বলেন,
اَنْ تُوْمِنَ بِاللهِ وَمَلٰٓئِكَتِهٖ وَكُتُبِهٖ وَرُسُلِهٖ وَالْيَوْمِ الْاٰخِرِ وَتُوْمِنَ بِالْقَدَرِ خَيْرِهٖ وَشَرِّهٖ ُ
অর্থ: ঈমান হচ্ছে আল্লাহ, তাঁর ফেরেশতাকুল, কিতাবসমূহ, নবী-রাসুল (আঃ) গণ, পরকাল এবং ভাগ্যের ভালো-মন্দের (ভালো-মন্দ আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকেই হয়) প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা (মুসলিম)।
প্রকৃতপক্ষে ইসলামের মূল বিষয়গুলোর প্রতি পূর্ণ বিশ্বাসকেই বলা হয় ঈমান। ঈমানের মৌলিক বিষয়গুলো আল্লাহর বাণী আল-কুরআন ও রাসুল (সাঃ)-এর পবিত্র হাদিসে বিস্তৃত ভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।
ঈমানে মুফাস্সালে ঈমানের মৌলিক বিষয়গুলো একত্রে বর্ণিত হয়েছে-
اٰمَنْتُ بِاللهِ وَمَلٰٓئِكَتِهٖ وَكُتُبِهٖ وَرُسُلِهٖ وَالْيَوْمِ الْاٰخِرِ وَالْقَدَرِ خَيْرِهٖ وَشَرِّه مِنَ اللهِ تَعَالٰى وَالْبَعْثِ بَعْدَ الْمَوْتِ ٖ ُ
অর্থ: আমি ঈমান আনলাম আল্লাহর প্রতি, তাঁর ফেরেশতাদের প্রতি, তাঁর কিতাবসমূহের প্রতি, তাঁর রাসুলগণের প্রতি, আখেরাতের প্রতি, তাকদিরের প্রতি যার ভালো-মন্দ আল্লাহতায়ালার নিকট থেকেই হয় এবং মৃত্যুর পর পুনরুত্থানের প্রতি।
উপরে উল্লিখিত সাতটি বিষয়ের প্রতি সুদৃঢ় আস্থা ও বিশ্বাস ব্যতীত ঈমানদার হওয়া যায় না। যিনি এগুলোতে পূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন করেন, তাকে মুমিন বলা হয়।
বস্তুতপক্ষে কোন মানুষ যখন ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে চায়, তখন তাকে রাসুল (সাঃ) কিংবা রাসুল (সাঃ) কর্তৃক মনোনীত অলি-আল্লাহ-এর দরবারে রাসুল (সাঃ) বা তাঁর মনোনীত অলি-আল্লাহর কাছ থেকে তওবা পড়ে কালেমা পাঠের মাধ্যমে বায়আত গ্রহণ করতে হবে। রাসুল (সাঃ) যতদিন এ পৃথিবীতে হায়াতে ছিলেন, তিনি জিন্দা কালেমা মানুষেকে পড়িয়েই বায়আত করেছেন। রাসুল (সাঃ)-এর ওফাতের পর তিনি যাকে জিন্দা কালেমা প্রদান করেন, তিনি বায়আত করিয়ে মানুষকে মুসলমান বা আত্মসমর্পণকারী করেছেন। এ সিলসিলার প্রথম জিন্দা কালেমার জিম্মাদার ছিলেন প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর (রাঃ)। তাঁর পরে রাসুল (সাঃ)-এর খলিফাদের মধ্যে থেকে এসেছেন তিনজন যথাক্রমে ওমর (রাঃ), ওসমান (রাঃ) এবং আলী (আঃ)। এ সিলসিলা বা সেজরা শরীফে খলিফা (রাঃ)-দের পরে প্রথম জিন্দা কালেমার জিম্মাদার হন হযরত সালমান ফারসী (রাঃ)।
সংক্ষেপে যদি বলতে হয়, ঈমানের মূল কথা হলো কালেমা। কালেমা আরবীতে নিচে দেয়া হলো-
لَاۤ اِلٰهَ اِلَّا اللهُ مُحَمَّدٌ رَّسُوْلُ اللهِ ُ
অর্থ: আল্লাহ ব্যতীত কোন মাবুদ নেই। মুহাম্মদ (সাঃ) আল্লাহর রাসুল।
প্রিয় হাবিব রাসুল (সাঃ) যখন নবুয়ত প্রাপ্ত হন, মহান আল্লাহ তাকে তাওহিদী কালেমা প্রদান করেন এবং বলেন মানুষকে কালেমার দাওয়াত দিতে। ইসলামের পরিভাষায় আল্লাহতায়ালাকে এক ও অদ্বিতীয় হিসেবে স্বীকার করে নেওয়াকে তাওহিদ বলা হয়। আল্লাহতায়ালাকে সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা, রিযিকদাতা ও ইবাদতের যোগ্য এক ও অদ্বিতীয় সত্তা হিসেবে বিশ্বাসের নামই তাওহিদ।
পুরুষদের মধ্যে সর্বপ্রথম তাওহিদী কালেমার বায়আত গ্রহণ করে মুসলমান হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন আবু বকর (রাঃ) আর মহিলাদের মধ্যে প্রথম মা খাদিজা (রাঃ)।
পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ বলেছেন,
لٰكِنِ الرَّسولُ وَالَّذينَ ءامَنوا مَعَهُ جٰهَدوا بِأَموٰلِهِم وَأَنفُسِهِم وَأُولٰئِكَ لَهُمُ الخَيرٰتُ وَأُولٰئِكَ هُمُ المُفلِحونَ ُ
অর্থ: কিন্তু রাসুল (সাঃ) এবং যারা তাঁর সঙ্গে ঈমান এনেছে, তাঁরা নিজ সম্পদ ও জীবন দ্বারা জিহাদ করেছে এবং তাঁদের জন্য বহু কল্যাণ রয়েছে, আর এরাই লক্ষ্যস্থলে পৌঁছেছে। (সূরা তওবা, আয়াত-৮৮)
মহান আল্লাহ বলেছেন,
وَعَدَ اللَّهُ الَّذينَ ءامَنوا وَعَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ مِنهُم مَغفِرَةً وَأَجرًا عَظيمًا ُ
অর্থ: যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকর্ম করেছে, আল্লাহ তাদের মহাপুরস্কারের ওয়াদা দিয়েছেন। (সূরা আল- ফাতহ, আয়াত-২৯)
কিছু সংখ্যক আনসার ইসলামের বায়আত গ্রহণের সময় আরজ করলেন, “হে আল্লাহর রাসুল! আপনি আপনার ইচ্ছানুসারে নিজের জন্য ও আল্লাহর জন্য শর্ত নির্ধারণ করুন। আমরা তা যথাযথ ভাবে পূরণ করতে থাকবো”। তদুত্তরে রাসুল (সাঃ) ইরশাদ করেন, “আল্লাহর জন্য তো এ শর্ত যে, তোমরা তিনি ব্যতীত অন্য কারো ইবাদত করো না। আর আমার জন্য এ শর্ত যে, যে জিনিসটি তোমরা নিজেদের জন্য পছন্দ করবে না, তা আমার জন্যও পছন্দ করবে না”। তখন তারা আরজ করলেন, “এ শর্তগুলো পূরণ করলে আমরা কি পাবো”? তখন রাসুল (সাঃ) ইরশাদ করলেন, “জান্নাত”। তখন তারা আরজ করলেন, “এটা তো বড় লাভজনক সওদা”! এ প্রসঙ্গে নিম্মোক্ত আয়াত শরীফ অবতীর্ণ হয়েছে। (রূহুল বয়ান)
إِنَّ اللَّهَ اشتَرىٰ مِنَ المُؤمِنينَ أَنفُسَهُم وَأَموٰلَهُم بِأَنَّ لَهُمُ الجَنَّةَ يُقٰتِلونَ فى سَبيلِ اللَّهِ فَيَقتُلونَ وَيُقتَلونَ وَعدًا عَلَيهِ حَقًّا فِى التَّورىٰةِ وَالإِنجيلِ وَالقُرءانِ وَمَن أَوفىٰ بِعَهدِهِ مِنَ اللَّهِ فَاستَبشِروا بِبَيعِكُمُ الَّذى بايَعتُم بِهِ وَذٰلِكَ هُوَ الفَوزُ العَظيمُ ُ
অর্থ: নিশ্চয় আল্লাহ মুসলমানদের নিকট থেকে তাদের সম্পদ ও জীবন খরিদ করে নিয়েছেন এর বিনিময়ে যে, তাদের জন্য জান্নাত রয়েছে। তারা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করবে অতঃপর তারা হত্যা করবে এবং নিহত হবে। তাঁর বদান্যতার দায়িত্বে সত্য প্রতিশ্রুতি-তাওরাত, ইঞ্জিল ও কুরআনে; এবং আল্লাহর চেয়ে বেশী অঙ্গীকার পূরণকারী কে আছে? সুতরাং তোমরা আনন্দ উদ্যাপন করো নিজেদের ব্যবসার জন্য, যা তোমরা তাঁর সাথে করেছ এবং এটাই মহাসাফল্য। (সূরা তওবা, আয়াত-১১১)
এ আয়াত থেকে এটা বোঝা গেল যে, মনিব ও দাসের মধ্যেকার বেচাকেনা বৈধ। কারণ মহান আল্লাহ আপন বান্দাদের থেকে সওদা করেছেন।
পরিশেষে এ কথা স্পষ্টরূপে বলা যায়, মহান আল্লাহতায়ালা মানুষের ক্বলব সৃষ্টি করে একে দেহের বাদশাহ বানিয়েছেন এবং অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে তাঁর অনুগত সৈনিক করে দিয়েছেন। বাদশাহ যদি সৎ হয় তার অনুগত সৈনিকও সৎ হবে। মহানবী (সাঃ) ইরশাদ করেছেন, “নিশ্চয় মানুষের শরীরে একটি মাংসপিন্ড রয়েছে, তা সংশোধন হলে সমস্ত শরীর সংশোধন হবে, তা বিনষ্ট হলে সারা শরীর বিনষ্ট হবে। আর তা হলো ক্বলব বা অন্তঃকরণ”। (বুখারি, মুসলিম)
অন্তর বা ক্বলবই হচ্ছে ঈমান ও তাকওয়া অথবা কুফরি, মুনাফেকি ও শিরকের স্থান। রাসুলেপাক (সাঃ) বলেছেন, “তাকওয়ার স্থান এখানে”, এ কথা বলে তিনি নিজ সিনা মুবারকের দিকে তিনবার ইঙ্গিত করলেন। (মুসলিম)
যখন কোন সাধারণ মানুষ নিখিল বিশ্বের হায়াতে মোজাদ্দেদের কাছে ঈমানের বায়আত গ্রহণ করবে তখন তার অন্তরের বিশ্বাস, মুখে উচ্চারণ এবং অন্তর ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গের আমলের মাধ্যমে ঈমান পূর্ণতা লাভ করবে। ক্বলব বা অন্তর প্রথমে বিশ্বাস করবে ও সত্যায়ন করবে, ফলে মুখ তার সাক্ষ্য দেবে। অতঃপর অন্তরের মধ্যে আমল শুরু হবে। আল্লাহ-রাসুল (সাঃ)-এর প্রতি মহব্বত, ভুলের জন্য ভয়ভীতি ও তওবার মাধ্যমে আশা-আকাক্সক্ষা অন্তরে স্থান লাভ করবে। এরপর অন্তরের আমল প্রকাশ করার জন্য জিকির, নামায, রোযা, কুরআন পাঠ, ইসলাম প্রচার প্রভৃতি আল্লাহর নৈকট্য দানকারী কর্মের মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গে তীব্র আন্দোলন সৃষ্টি হবে। বস্তুত শরীর হচ্ছে অন্তর বা ক্বলবের অনুসরণকারী। তাই অন্তরে যখন আল্লাহ-রাসুল (সাঃ)-এর প্রতি আনুগত্য স্থিরতা লাভ করবে কোন বায়আত গ্রহণকারীর, তখন যে কোনভাবে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দ্বারা তার প্রকাশ ঘটবেই। অর্থাৎ ইসলাম ধর্মে প্রবেশের বায়আত গ্রহণের মাধ্যমে আল্লাহ-রাসুল (সাঃ) নির্ধারিত বিধিবিধান মুখে স্বীকার করা, অন্তরে বিশ্বাস করা এবং তদানুযায়ী আমল করাকে ঈমান বলা হয়।