মোজাদ্দেদিয়া তরিকার শ্রেষ্ঠত্ব

নবীকুল শিরোমণি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর বিদায় নেবার হাজার বছর পর ১৪ শাওয়াল ৯৭১ হিজরীতে সুবহে সাদেকের সময় ভারতের সেরহিন্দে ভূমিষ্ঠ হয় এক মহাপবিত্র নূর, যার নাম রাখা হয় শায়েখ আহমদ ফারূকী সেরহিন্দি (রঃ)। তিনিই হচ্ছেন তরিকতের শেষ ঈমাম হযরত আহমদ মোজাদ্দেদ আলফেসানি (রঃ)। হযরত মোজাদ্দেদ আলফেসানি (রঃ) ছিলেন ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর (রাঃ)-এর বংশধর। হযরত ওমর (রাঃ)-এর পুত্র বিখ্যাত সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ (রাঃ) ঈমাম হাসান (রাঃ)-এর কন্যা ফাতেমা (রাঃ) কে বিবাহ করেন। তাঁরই বংশে হযরত মোজাদ্দেদ (রঃ)-এর জন্ম। তিনি ছিলেন পিতার দিক হতে ফারূকী এবং মাতার দিক হতে সৈয়দ। মোজাদ্দেদ আলফেসানি (রঃ) রাসুলেপাক (সাঃ)-এর মতো খৎনা অবস্থায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি সাধারণ শিশুদের মতো ক্রন্দন করতেন না। তাঁর শরীর ও পোশাক মুবারক কখনও অপবিত্র হতো না।

মোজাদ্দেদ অর্থ নবায়নকারী, পুনর্জীবন দানকারী ও সংস্কারক। ইসলামী পরিভাষায় মোজাদ্দেদ হচ্ছেন মহান আল্লাহর এমন বান্দা যিনি রাসুল (সাঃ)-এর উত্তরাধিকারী হিসেবে দ্বীন ইসলামকে পুনর্জীবিত করেন। “আলফ” অর্থ হাজার আর “সানি” অর্থ দ্বিতীয়। শায়খ আহমদ (রঃ) হচ্ছেন দ্বিতীয় হাজার বছরের জন্য মোজাদ্দেদ, যার নূরের বরকতময় ওসিলায় কেয়ামত পর্যন্ত সত্যসন্ধানী মানুষ বেদাত-কুফরীর অন্ধকার হতে পরিত্রাণ পেতে থাকবে।

মহাপুরুষগণের আগমনের বার্তা আগে থেকেই ঘোষিত হতে থাকে। রাসুলেপাক (সাঃ)-এর আখেরী নবী হিসেবে আগমনের বার্তা যেমন পূর্ববর্তী নবী-রাসুল (আঃ) গণ বর্ণনা করেছিলেন, তেমনি ভাবে মোজাদ্দেদ আলফেসানি (রঃ)-এর আগমনের সংবাদও অলি-আল্লাহ (রঃ) গণ কর্তৃক বর্ণিত হয়েছিলো। স্বয়ং নবী করিম (সাঃ) দ্বিতীয় হাজার বছরের মোজাদ্দেদের আবির্ভাবের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। দয়াল নবী (সাঃ) ইরশাদ করেছেন, হিজরী একাদশ শতাব্দীর শুরুতে মহান আল্লাহ এমন এক ব্যক্তিকে প্রেরণ করবেন যিনি এক বৃহৎ নূর! তাঁর নাম হবে আমার নামের অনুরূপ। দুই অত্যাচারী বাদশাহর মধ্যবর্তী সময়ে তিনি আবির্ভূত হবেন এবং তাঁর শাফাআতে অসংখ্য ব্যক্তি বেহেশতে প্রবেশ করবে। রওজাতুল কাইওমিয়া নামক গ্রন্থে এ হাদিসটি বর্ণিত আছে। এছাড়া আল্লামা সুয়্যূতি (রঃ) তাঁর জমাউলজমা গ্রন্থে একই হাদিস বর্ণনা করেছেন। এ হাদিসটি সম্পূর্ণরূপে হযরত মোজাদ্দেদ আলফেসানি (রঃ)-এর প্রতি প্রযোজ্য; যেহেতু তাঁর পবিত্র নাম “শায়েখ আহমদ” ছিল এবং তিনি হিজরী একাদশ শতাব্দীর প্রারম্ভে আকবর ও জাহাঙ্গীর নামক দুই অত্যাচারী ইসলাম বিরোধী মোঘল সম্রাটের যুগে মোজাদ্দেদ বা ইসলাম পুনর্জীবন দানকারী হিসেবে প্রকাশিত হয়েছিলেন।

তরিকতের ঈমাম হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রঃ)-এর খেরকা মুবারক কাদেরিয়া নেসবতের কামালত পূর্ণ করে সাহেবজাদা সৈয়দ তাজউদ্দিন আব্দুর রাজ্জাক (রঃ)-এর কাছে দিয়ে এ নির্দেশ প্রদান করে যান যে, যখন ঐ মহান বুজুর্গের আত্মপ্রকাশ হবে, তখন যেন এ খেরকা শরীফ তাঁকে পৌঁছে দেয়া হয়। বড় পীর (রঃ) এমন আদেশ দেন কারণ একদিন তিনি মুরাকাবায় বসলে এভাবে এলহাম প্রাপ্ত হন যে, “তোমার পাঁচশ বছর পরে পৃথিবী শিরক-বেদাতের তমসায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়বে। সেই সময়ে রাসুল (সাঃ)-এর উম্মতের মধ্যে থেকে একজন অদ্বিতীয় অলি-আল্লাহ জন্মগ্রহণ করবেন এবং শিরক, বেদাত ও নাস্তিকতাকে ধ্বংস করবেন। স্পর্শমণিতুল্য হবে তাঁর সহবত। তাঁর সাহেবজাদা ও খলিফাগণ আল্লাহর খাস দরবারের মেহমান হবেন”। এছাড়া তরিকতের ঈমাম খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী (রঃ), বাহাউদ্দিন নকশবন্দী (রঃ) সহ অসংখ্য অলি-আল্লাহ (রঃ) গণ শেষ তরিকতের শেষ ঈমাম মোজাদ্দেদ আলফেসানি (রঃ) এর আগমনী বার্তা ঘোষণা করে গেছেন তাঁদের জীবদ্দশায়।

হিজরী ১০১০ সালের ১০ রবিউল আউয়াল শুক্রবার সুবহে সাদেকের সময় যখন শায়েখ আহমদ (রঃ) নির্জনে ধ্যানরত, এমন সময় নবী করিম (সাঃ) তশরীফ আনলেন। সঙ্গে সকল নবী-রাসুল (আঃ), আউলিয়া কেরাম (রঃ) এবং অসংখ্য ফেরেশতা (আঃ)। রাসুলেপাক (সাঃ) তাঁর পবিত্র হাতে হযরত শায়েখ আহমদ (রঃ) কে একটি অমূল্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ খেরকা মুবারক পরিয়ে দিয়ে বললেন, শায়খ আহমদ! মোজাদ্দেদ-এর প্রতীক স্বরূপ এই বিশেষ “খিলআত” তোমাকে পরিয়ে দেয়া হলো। এখন থেকে তুমি মোজাদ্দেদ আলফেসানি অর্থাৎ দ্বিতীয় সহস্রাব্দের দ্বীন ইসলামের সংস্কারক। আমার উম্মতের দ্বীন ও দুনিয়ার যাবতীয় দায়িত্ব আজ হতে তোমার উপর অর্পিত হলো। জন্ম হলো ইসলামের ইতিহাসে শেষ তরিকা “তরিকায়ে মোজাদ্দেদিয়া” আর যার ঈমাম হলেন হযরত মোজাদ্দেদ আলফেসানি (রঃ)।

মোজাদ্দেদ (রঃ) পূর্ববর্তী সকল তরিকতের ঈমাম (রঃ) গণের খলিফা এবং পূর্ববর্তী সকলের কাছ থেকেই তাঁদের স্ব স্ব নেসবতের কামালত রূহানীতে তাঁর উপর অবধারিত ভাবে সমর্পিত হয়েছিলো এবং এ জন্য তিনি এবং তাঁর সিলসিলার খলিফাগণ কেয়ামত পর্যন্ত সকল তরিকার পক্ষেই খেদমত করে যাবেন এবং পূর্ববর্তী সকলেই মোজাদ্দেদ আলফেসানি (রঃ)-এর কাছ থেকে পারিশ্রমিক পেতে থাকবেন। কিন্তু যেহেতু নবী (আঃ) গণের পরে শ্রেষ্ঠ মানব হযরত সিদ্দীকে আকবর (রাঃ) হতে নকশবন্দিয়া তরিকার উৎপত্তি এবং এতে দৃঢ়তার সাথে সুন্নতের অনুসরণ ও বেদাত বর্জন করা হয়, তাই ইসলামের সংস্কারের বিশেষ খেদমত সম্পাদনের ক্ষেত্রে মোজাদ্দেদিয়া তরিকা সর্বাপেক্ষা যোগ্যতাপূর্ণ। এ জন্য শায়খ আহমদ (রঃ)-এর তরিকাকে নকশবন্দি মোজাদ্দেদিয়া তরিকা বলেও অভিহিত করা হয় এবং নিঃসন্দেহে এ কারণে অন্যান্য তরিকা হতে এ তরিকা শ্রেষ্ঠ। শ্রেষ্ঠত্বের আরেকটি অন্যতম কারণ হলো আল্লাহ প্রাপ্তির যাবতীয় পথ হতে নকশবন্দি মোজাদ্দেদিয়া তরিকা নিকটতর। অন্যান্য তরিকার শেষ এ তরিকায় প্রারম্ভে নিহিত। এ তরিকার আত্মিক সম্বন্ধ অন্যান্য তরিকার আত্মিক সম্বন্ধ হতে উচ্চতর।

নকশবন্দি মোজাদ্দেদিয়া তরিকা এক অনন্য তরিকা। সূুক্ষাতিসূক্ষ মারেফত ও খাস বরকতে পরিপূর্ণ এ উচ্চ তরিকা। এ তরিকা অবিকল সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ)-এর তরিকা। সাহাবা (রাঃ) গণ রাসুলেপাক (সাঃ)-এর প্রথম সাক্ষাতেই যা লাভ করেছিলেন, অন্যান্য তরিকার বুজুর্গ (রঃ) গণ তা সর্বশেষে পেয়ে থাকেন। কিন্তু নকশবন্দি মোজাদ্দেদিয়া তরিকার বুজুর্গ (রঃ) গণ সাহাবী (রাঃ) গণের অনুরূপ, শেষ মাকামের বস্তু প্রারম্ভেই প্রাপ্ত হয়ে থাকেন। তাহলে শেষ মাকামে উপনীত হবার পর এ তরিকার বুজুর্গ (রঃ) গণের প্রাপ্তি অন্যরা কিভাবে অনুভব করবে!

অন্যান্য তরিকতের বুজুর্গ (রঃ) গণ মহান আল্লাহপাকের পবিত্র নূরের দিকে ধাবিত হন তাঁর প্রতি প্রেম (জজ্বা) এবং একনিষ্ঠ মহব্বতের দ্বারা নৈকট্য লাভের জন্য। আর এ নকশবন্দি মোজাদ্দেদিয়া তরিকতের বুজুর্গ (রঃ) গণ নূরের মালিকের মধ্যে অবস্থান করেন। এ জন্য নকশবন্দি মোজাদ্দেদিয়া তরিকাই শ্রেষ্ঠ।

অন্যান্য তরিকার বুজুর্গ (রঃ) গণের সায়ের ক্বলবের বর্হিভাগ পর্যন্ত হয়ে থাকে কিন্তু এ তরিকার বুজুর্গ (রঃ) গণের সায়ের ক্বলবের অভ্যন্তর পর্যন্ত হয়ে থাকে। এ জন্যও এ তরিকা শ্রেষ্ঠ অন্যান্য তরিকা হতে।

সম্রাট আকবর তৎকালীন ভন্ড আলেম আবুল ফজল, কিছু ভন্ড সুফী এবং অন্যান্য ধর্মের নেতাদের প্রভাবে দ্বীন-এ এলাহী প্রবর্তন করেন এবং কালেমা পরিবর্তন করে লা ইলাহা ইল্লালাহু আকবর খলিফাতুল্লাহ করেন। নামায, রোযা, যাকাত, আযান, গরু কোরবানী প্রায় নিষিদ্ধ করে দেন। সম্রাট জাহাঙ্গীর ও তার স্ত্রী নূরজাহানের ফিত্নাও পবিত্র ইসলামকে ধ্বংস প্রাপ্ত করে দেয়। ঐ সময় শুধু হিন্দুস্থানই নয় বরং কাবুল, তুর্কীস্থান ও খোরাশানেও দ্বীন ইসলামের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক ছিলো। মোজাদ্দেদ আলফেসানি (রঃ) উভয় সম্রাটের রাজত্বকালে দ্বীন ইসলাম বিরোধী শাহী ফিত্না ও বেদ্বীনী কার্যকলাপ; দুনিয়াদার আলেম, সুফী, রাফিজী ও মুশরিকদের ফিত্না; রাশি রাশি বেদাতের প্রচলন; দ্বীন ইসলাম বিরোধী আকিদা ও আল্লাহকে অস্বীকার সর্বোপরি দ্বীন ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করার বিরুদ্ধে একাকী হিমালয়ের মতো রুখে দাঁড়ান এবং বদ-দ্বীনি কার্যকলাপের আমূল সংস্কারপূর্বক দ্বীন ইসলামকে সতেজ ও পরিবেশকে কলুষমুক্ত করে আল্লাহ ও রাসুলেপাক (সাঃ)-এর অর্পিত দ্বি-সহস্রাব্দের ইসলামের সংস্কারকের দায়িত্ব সফল ও পরিপূর্ণ ভাবে পালন করেন। এ মহান বুজুর্গ (রঃ) তাঁর মাবদা ওয়া মাআদ গ্রন্থে লিখেছেন, আমি আমার ক্বলবে শুনতে পেলাম, “আপনাকে মাফ করলাম এবং যে ব্যক্তি মধ্যস্থতায় অথবা বিনা মধ্যস্থতায় রোজ কেয়ামত পর্যন্ত আমার দিকে আপনাকে ওসিলা গ্রহণ করলো, তাকেও মাফ করে দিলাম”। এই বাক্য পুন: পুন: আমার অন্তরে ধ্বনিত হতে লাগলো। অবশেষে যখন এই ব্যাপারে কোন প্রকার সন্দেহ অবশিষ্ট রইলো না, তখন উক্ত নেয়ামত প্রকাশ করার জন্য আদিষ্ট হলাম। এ মহান বুজুর্গ (রঃ) ১০৩৪ হিজরীর ২৭ সফর পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে মহান আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে যান। মহান আল্লাহ সত্য অন্বেষণকারীদের এ নেসবতে দাখিল হবার জন্য কবুল করে নিন।