কামেল পীরের ওসিলা ছাড়া খোদাকে কখনও চেনা যায় না এবং উনাদের অনুগ্রহ ছাড়া কখনও নফ্স পাক-পবিত্র হয়না। খোদাকে চেনার জন্য কামেল মুর্শিদ স্পর্শমণিতুল্য। তাই মওলানা জালালুদ্দিন রুমী (রঃ) বলেছেন, “তুমি যত খারাপই হওনা কেন মুর্শিদে কামেলের সঙ্গ লাভ করলে অমূল্য রত্ন হয়ে যাবে”। অর্থাৎ একজন খারাপ লোক কামেল পীরের তাছিরে পরিবর্তিত হয়ে আল্লাহর প্রিয় বান্দায় পরিণত হয়।
ঈমাম গাজ্জালী (রঃ) ‘কিমিয়া সাদাতে’ লিখেছেন, “এমন পীরের ওসিলা ধরতে হবে যিনি নিজে কামেল এবং অন্যকেও কামেল বানিয়ে দিতে পারেন”। মূলত কামেলে মোকাম্মেল পীর ছাড়া কেউ অন্যকে কামেল বা কামেলে মোকাম্মেল পীর বানাতে পারেন না। ঈমাম গাজ্জালী (রঃ) ‘এহিয়াউল উলুম’ কিতাবে লিখেছেন, “শায়খ (কামেলে মোকাম্মেল পীর) নিজের দলের মধ্যে এইরূপ, যেরূপ উম্মতের মধ্যে নবী (আঃ)”।
কেউ যদি আল্লাহর সাথে মিশতে চায় তবে কামেল পীরের ধুলা তাকে হয়ে যেতে হবে, অর্থাৎ নিজকে ফানা করে দিয়ে আল্লাহর মহব্বতে ডুবে যেতে হবে। মহব্বতের সাথে কোন ব্যক্তির খেদমত করলে যদি ক্বলবে আল্লাহর নূর অবতীর্ণ হয়, যদি মৃত ক্বলবে জিকির জারি হয়; এসব গুণের কোন ফকির-মিছকিনকে পেলেও তাঁর জন্য জান ও মাল দ্বারা কোরবানী হতে সদা প্রস্তুত থাকতে হবে। এ জন্যই ঈমাম গাজ্জালী (রঃ) লিখেছেন, “সমস্ত ত্যাগ করে তুমি কামেল পীরের গোলাম হয়ে যাও, তবেই ধর্মের স্বাদ গ্রহণ করতে সমর্থ হবে”।
পবিত্র কুরআনে সূরা কাহাফে আল্লাহ প্রকাশ করেছেন, হযরত মুসা (আঃ) উলুল আজম পয়গম্বর হয়েও আল্লাহকে চেনার গুপ্ত নিয়ামত (এল্মে লাদুন্নী) হাসিলের জন্য আপন শিষ্য ইউশাকে সঙ্গে নিয়ে হযরত খাজা খিজির (আঃ)-এর পিছে পিছে কিভাবে ঘুরেছিলেন। তবে এ শেষ জামানায় সাধারণ আম-জনতা ও আলেমগণের খোদাকে চিনার উদ্দেশ্যে কামেলে মোকাম্মেল আউলিয়ার গোলামী স্বীকার করতে লজ্জা কিসের?
এক রেওয়ায়েতে আছে, একদা রাসুলেপাক (সাঃ) উম্মতের চিন্তায় তিনদিন যাবৎ গারে হেরায় সেজদায় পড়েছিলেন। তাঁর ক্রন্দনে অরণ্যের পশু-পক্ষীরা আহার নিদ্রা পরিত্যাগ করে ক্রন্দন করছিলো। আহ্লে বায়আত ও সাহাবা (রাঃ) গণ আহার নিদ্রা পরিত্যাগ করে রাসুল (সাঃ)-এর শোকে অস্থির হয়ে অবিরত ভাবে কাঁদছিলেন। গারে হেরার অনতিদূরে ময়দানের ভেতর এক রাখালকে দেখে সাহাবী (রাঃ) গণ রাসুল (সাঃ)-এর কথা তাকে জিজ্ঞাসা করলেন। রাখাল যখন নবী (সাঃ)-এর অস্পষ্ট সন্ধান সাহাবী (রাঃ) দের জানালো তখন সাহাবী (রাঃ) গণের যেরূপ হয়েছিলো, মওলানা রুমী (রঃ) তা প্রকাশ করেছিলেন এভাবে- “সাহাবী (রাঃ) গণ সকলেই রাখালের পায়ে পড়ে গেলেন যে সে ঐ দোজাহানের বাদশা রাসুল (সাঃ)-এর ঠিকানা বলে দিবে”।
রাসুল (সাঃ) নিকটেই ছিলেন কিন্তু সাহাবী (রাঃ)-দের একটুও দেরী সহ্য হচ্ছিল না বলে তারা সামান্য রাখালের পায়ে পড়েছিলেন। আহা! আমরা আজ কত শতাব্দী হয়ে গেলো রাসুল (সাঃ)-এর অনুপস্থিতি সহ্য করছি। তবে আমরা কেন আল্লাহ ও রাসুল (সাঃ)-এর মিলনের উদ্দেশ্যে তাঁদেরই নির্দেশ মোতাবেক একজন কামেলে মোকাম্মেল আউলিয়ার কদম মুবারকে নিজেদের সমর্পিত করতে ইতস্তত করি!
কামেলে মোকাম্মেল পীর যে হুকুম করেন, তা যদি শরীয়ত বিরুদ্ধও বিবেচিত হয়, মুরিদ বিনা বাক্য ব্যয়ে তা প্রতিপালন করবে। কারণ আল্লাহর অলিরা কখনও শরীয়তের বরখেলাফ কাজ করেন না, মুরিদের যখন বুঝ-জ্ঞান খুলবে তখন তা বুঝতে পারবে। হযরত মোজাদ্দেদ আলফেসানি (রঃ) তাঁর ২৯২ মকতুবে লিখেছেন, “হাদিস শরীফে এসেছে যে, তোমাদের মধ্যে কেহই মুমিন হবে না, যে পর্যন্ত তার যাবতীয় আকাঙ্খা আমার আনিত শরীয়তের অনুকূল না হয়”।
এক রেওয়ায়েতে আছে, একদা মওলানা জালালুদ্দিন রুমী (রঃ) তাঁর লেখা যাবতীয় কিতাব (কথিত আছে সাত উষ্ট্রগাড়ী) নিয়ে সফরে ছিলেন। পথিমধ্যে শামস তিবরিজী (রঃ) তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, গাড়ীতে এগুলো কিসের এত বই আর কিতাব? রুমী (রঃ) বিরক্ত হয়ে উত্তর দিলেন, ওহে পাগল! এ সব বোঝার সাধ্য তোমার নেই। তখন শামস তিবরিজী (রঃ) রাগতস্বরে বললেন, যা! আমিই যদি না বুঝি তবে তোর এসব কিতাব আমি পুড়িয়ে দিলাম। মুহুর্তের মধ্যে যাবতীয় মূল্যবান কিতাব পুড়ে ছাই হয়ে গেলো এবং শামস তিবরিজী (রঃ) সেখান থেকে হারিয়ে গেলেন। ঘটনার আকস্মিকতায় রুমী (রঃ) হতবিহŸল হয়ে পড়লেন এবং অনুধাবন করলেন, আমি সারাজীবন কত সাধনা করে ইসলামের জন্য কতো কিতাব পড়েছি, জ্ঞান অর্জন করেছি, কত কিতাব রচনা করেছি, আর এক পাগলের আদেশে মূহুর্তের মধ্যে সব পুড়ে গেলো! কে এই পাগল যার ইচ্ছা আল্লাহ সঙ্গে সঙ্গে কবুল করলেন! অনেক খোঁজ খবর করে জানতে পারলেন এ ছদ্দবেশী পাগল হলেন তৎকালীন বিখ্যাত বুজুর্গ কামেলে মোকাম্মেল পীর শামস তিবরিজী (রঃ)।
রুমী (রঃ) কালবিলম্ব না করে শামস তিবরিজী (রঃ) কে ব্যাপক অনুসন্ধান করে তাঁর পবিত্র কদমে হাজির হয়ে বিনীতভাবে বায়আত হতে বা ইসলাম ধর্ম গ্রহণের আগ্রহ প্রকাশ করলেন। শামস তিবরিজী (রঃ) বললেন, আমার আদেশ যদি মেনে চলো তবে আমি তরিকা দেবো। রুমী (রঃ) রাজী হলেন মুর্শিদের সকল আদেশ মান্য করার এবং বায়আত হয়ে তরিকা গ্রহণ করলেন। এরপর শামস তিবরিজী (রঃ) বললেন, আজ তুমি এশার নামায পড়বে না আর আমি কাল সকালে না আসা পর্যন্ত এখানেই থাকো বলে ঘরে বন্দী করে চলে গেলেন। সময় গড়াতে থাকে। রুমী (রঃ)-এর অস্থিরতা বাড়তে থাকে আর পায়চারী করতে থাকেন এশার ওয়াক্ত বয়ে চলার সঙ্গে সঙ্গে। রুমী (রঃ) মনে মনে ভাবতে লাগলেন, এ কেমন শরীয়ত বিরুদ্ধ আদেশ! আমি সারা জীবন এক ওয়াক্ত নামায কাযা করিনি আর আজ আমার পীরের অদ্ভুত আদেশে নামায কাযা হতে যাচ্ছে! এশা ওয়াক্ত যখন প্রায় শেষ তখন রুমী (রঃ) অস্থিরতার মধ্যে শুধু এশার ফরয নামায আদায় করলেন এ ভেবে যে, মহান আল্লাহকে বলতে পারবেন যে, আল্লাহ তোমার ওয়াক্তের ফরয তো অন্তত আদায় করেছি, কাযা করিনি! এরূপ মনে মনে সওয়াল-জওয়াব করতে করতে শামস তিবরিজী (রঃ)-এর ওপর এক সময় ক্ষোভও তৈরি হলো রুমী (রঃ)-এর। এক সময় ক্লান্তি এবং ক্ষোভে ঘুমিয়েও পড়লেন। ঘুমের মধ্যে স্বপ্নযোগে দেখলেন, দোজাহানের বাদশা হুজুরেপাক (সাঃ) তশরীফ এনেছেন এবং বলছেন, “ওহে রুমী! তুমি আল্লাহর ফরয তো বেশ আদায় করলে কিন্তু আমার সুন্নত তো আদায় করলে না। আমি কি তোমার কেউ না”! মওলানা রুমী (রঃ) এ স্বপ্ন দেখে কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে মূহুর্তেই জেগে উঠলেন এবং তীব্র অস্বস্তি নিয়ে সুন্নত নামায না আদায়ের জন্য নিজেকে র্ভৎসনা করতে লাগলেন বার বার। তিনি শামস তিবরিজী (রঃ)-এর ওপর আরো রেগে গেলেন নামায না পড়ার আদেশ দিয়ে তাকে এভাবে অপ্রস্তুত করে দেবার জন্য। বাকী রাত আর ঘুম আসলো না, সারারাত বদ্ধ ঘরের ভেতর রুমী (রঃ) পায়চারী করতে থাকলেন সকালের অপেক্ষায়, শামস তিবরিজী (রঃ)-এর মোকাবেলার ইচ্ছায়!
যখন ফজরের ওয়াক্ত শুরু হলো তখন শামস তিবরিজী (রঃ) ঘরে প্রবেশ করলেন। রুমী (রঃ) প্রচন্ড ভাবে রেগে হুজুরপাককে সওয়াল করতে লাগলেন এবং রাতের ঘটনা বর্ণনা করে সমুচিত জবাব চাইতে লাগলেন। রুমী (রঃ) খেয়াল করলেন, হুজুরপাক ঘরে ঢোকার পর থেকেই শুধু মিটমিট করে হাসছেন কিন্তু কিছুই বলছেন না। হাসি দেখে রুমী (রঃ) আরো রেগে যেতে থাকলেন। পরিশেষে যখন রুমী (রঃ) আর ধৈর্য রাখতে পারছেন না তখন শামস তিবরিজী (রঃ) বললেন, ওহে পাগল! তুমি যদি আমার আদেশ পরিপূর্ণ ভাবে পালন করতে, তবে যেভাবে রাসুলেপাক (সাঃ) তোমার কাছে হাজির হয়ে দেখা দিয়েছেন, মহান রাব্বুল আলামীন আল্লাহও ঠিক সেভাবে তোমাকে দেখা দিতেন। পুরো ব্যাপার রুমী (রঃ) আঁচ করলেন মূহুর্তের মধ্যে আর তাঁর রাগ পানি হয়ে গেলো নিজের ভুল বুঝতে পেরে। আর দেরী না করে তিনি হুজুরপাকের পবিত্র কদমে ঝাঁপিয়ে পড়লেন এবং বার বার ক্ষমা চাইতে লাগলেন।
পরবর্তীকালে মওলানা রুমী (রঃ) তার মসনবী শরীফে লিখেছেন, “এক মূহুর্ত অলি-আল্লাহর সংসর্গে বাস করা একশ বছরের বেরিয়া (অকপট) বন্দেগীর অপেক্ষাও উওম”।
পৃথিবীতে একজন মানুষের দুইবার জন্ম হয় যদি সে মুমিন হয়। প্রথমে দেহের জন্ম হয় বাবা-মায়ের ওসিলায় আর দ্বিতীয়বার ক্বলবের জন্ম হয় পীরের ওসিলায় তরিকা গ্রহণ করলে। এই প্রকাশ্য জগৎ পিতা-মাতার মাধ্যমে জন্ম নিয়ে দেখা যায় কিন্তু অদৃশ্য জগৎ অর্থাৎ আল্লাহ, রাসুল (সাঃ) এবং সকল সৃষ্টির রহস্য দিলের (ক্বলবের) বাবা পীরের দ্বারা দেখা যায়।
সূর্যের প্রখর তেজ সর্বত্র বিদ্যমান আছে, তথাপি তার তেজে কোন কিছুতে সাধারণ ভাবে আগুন ধরে যায়না। আবার একখন্ড আতশী কাঁচকে সূর্যের দিকে ধরলে তার নিচে একখন্ড সাদা বা কালো কাগজ ধরলে তাতে তৎক্ষণাৎ আগুন ধরে যায়। একই ভাবে আল্লাহর নূর সর্বত্র বিদ্যমান থাকা সত্তে¡ও কারো ক্বলবে এমনি এমনি সে তাছির ধরে না, কিন্তু যেই মুর্শিদকে মধ্যস্থ করে আল্লাহর দিকে মোতাওয়াজ্জোহ হবে অমনি ক্বলবে আল্লাহর জালালের অগ্নি প্রজ্জ্বলিত হয়ে উঠবে। বিজ্ঞানের কল্যাণে কাঁচের কি শক্তি! তবে বেলায়েতের তাছিরে মুর্শিদে কামেলের দিল যে অসীম তেজ সম্পন্ন হবে তাতে আর আশ্চর্য কি?
মকামাতে এমামে রব্বানীতে লিখিত আছে, “পীরের সুরৎ (চেহারা মুবারক) নিজের দুই ভুরুর মাঝখানে অথবা দিলের ভিতর খেয়াল করবে। যখন এই ভাব প্রবল হবে তখন প্রত্যেক বস্তুতেই পীরের সুরৎ দেখা যাবে এবং একেই ফানাফিশ শায়খ বলে। হযরত মওলানা খাজা মুহাম্মদ মাছুম কামাল বেন্নে মোজাদ্দেদ আলফেসানি (রঃ) বলেছেন, “নক্শবন্দি মোজাদ্দেদিয়া তরিকা মহব্বত ও তাছওয়াফের ভিত্তিতে সংস্থাপিত। পীরের মহব্বত দ্বারা প্রকৃত খোদা অন্বেষী ব্যক্তি প্রতি মূহুর্তে পীর হতে ফায়েজ হাসিল করে থাকে”।
এ তরিকায় উন্নতি লাভের প্রধান শর্ত এই যে, পীরের প্রেম ও ভক্তি দৃঢ় ভাবে অন্তরে পোষণ করতে হবে যেন হুজুরপাকের চেহারা মুবারক অন্তরে অঙ্কিত থাকে মুরিদের। সাহাবী (রাঃ) গণ নবী করিম (সাঃ)-এর সঙ্গ লাভ করেছিলেন বলে পয়গম্বর (আঃ) ছাড়া সমস্ত লোক অপেক্ষা তাঁদের মর্যাদা অধিক। এমনকি ওয়ায়েছ কোরনী (রঃ) আশেকে রাসুল হয়েও রাসুল (সাঃ)-এর সাথে সরাসরি সাক্ষাৎ না হবার কারণে সাহাবী (রাঃ) গণের সমান মর্যাদা প্রাপ্ত হতে পারেননি।
পীরের মহব্বত খোদা প্রাপ্তির প্রধান অবলম্বন। মকতুবাত শরীফে হযরত মোজাদ্দেদ আলফেসানি (রঃ) লিখেছেন, “যে সময় বিনা চেষ্টায় মুরিদের দিল পীরের মহব্বতে ভরতে থাকে তখনই পীর ও মুরিদের মধ্যে গাঢ় সম্পর্ক স্থাপিত হয়। পীরের এশ্কই (প্রেমাধিক্যই) খোদা প্রাপ্তির সর্বাপেক্ষা নিকটস্থ ও সহজসাধ্য সোপান, যে ব্যক্তি আপন পীরের এশ্ক হাসিল করতে সমর্থ হয়েছে, সেই ব্যক্তি মহাসৌভাগ্যবান হয়েছে। হাজার মুরিদের মধ্যে কদাচিৎ কারো ভাগ্যে পীরের পূর্ণ এশ্ক লাভ হয়ে থাকে। এ ধরণের মুরিদই মহাযোগ্যতা ও সৌভাগ্য লাভে সমর্থ হয়। এই মুুরিদ অল্প সময়ের মধ্যে কামেলে মোকাম্মেল পীরের সহবতে থেকে পীরের সমস্ত আত্মিক গুণ আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়”।
দিনরাত পীরের ক্বলবের দিকে আপন ক্বলব বা দিল রুজু করে রাখলে ঐ ক্বলবে আল্লাহর নাম অঙ্কিত হতে থাকে এবং আল্লাহকে প্রত্যেক দমে স্মরণ রাখার ক্ষমতা জন্ম নেয়।
হযরত মওলানা সৈয়দ ওয়াজেদ আলী (রঃ) যিনি আল্লাহ ও রাসুলেপাক (সাঃ)-এর ভেদের ও মহব্বতের সমুদ্র, তিনি বলেছেন, “আপন পীরকে কোন রকম দুঃখ দিওনা। সকল অপরাধের সংশোধন আছে কিন্তু পীরকে দুঃখ দেওয়ার অপরাধের কোন কালেই সংশোধন নাই। পীরের রেজামন্দির উপর আল্লাহ রাজী আছেন এ বিশ্বাস রাখ। পীরের মর্জির (ইচ্ছার) উপর রাজী থাকবা। পীরের নিকট আপন হাউসে আসবে কিন্তু বিনা ওজরে বেহুকুমে চলে গেলে নোক্ছানীতে পড়বা”।
পরিশেষে হযরত মোজাদ্দেদ আলফেসানি (রঃ) কর্তৃক মকতুবাত শরীফের ২৯২ মকতুবে উল্লিখিত তরিকতে মুর্শিদের প্রতি মুরিদের আদব ও মহব্বতের দিকনির্দেশনা বিবৃত হলো, “আপন দিলকে সমস্ত দিক হতে ফিরিয়ে পীরের দিলের দিকে মোতওয়াজ্জোহ রাখবে। পীরের সাক্ষাতে তাঁর বিনা অনুমতিতে কোন নফল কাজ ও জিকির করবে না। তাঁর সম্মুখে তাঁর দিকে ছাড়া অন্য দিকে তাকাবে না। সর্বান্তকরণে তাঁর উপর তন্ময় হয়ে থাকবে। এমন কি তাঁর হুকুম ছাড়া জিকির করবেনা। তাঁর সম্মুখে ফরয ও সুন্নত ব্যতীত বিনা আদেশে নফল পড়বে না। মুরিদ এমন স্থানে দাঁড়াবে না, যাতে তার ছায়া পীরের কাপড় বা তাঁর ছায়ার উপরে পড়ে। পীরের জায়নামাজে পা রাখবে না। তাঁর অজুর জায়গায় অজু-গোসল করবে না এবং তার অজু-গোসলের পাত্র ব্যবহার করবে না। তাঁর নিজস্ব কোন দ্রব্য ব্যবহার করবে না। পীরের সম্মুখে বিনা হুকুমে পানাহার করবে না এবং অন্য কারো সাথে কথা বলবে না; বরং কোন দিকেই লক্ষ্য করবে না। পীরের অসাক্ষাতে তিনি যেদিকে আছেন সেদিকে পা লম্বা করবে না ও থুথু নিক্ষেপ করবে না। পীর যে কোন কাজই করুক না কেন, তা সত্য ও ঠিক বলে জানবে যদিও বাহ্যত তা অন্যায় বলে প্রতীয়মান হয়। যেহেতু তিনি যা করেন, তা এল্হাম বা ঐশী দিকনির্দেশনা ও আল্লাহর আদেশক্রমে করে থাকেন; সুতরাং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সমালোচনার কোন সুযোগ নেই। ক্ষুদ্র-বৃহৎ সর্ববিষয়ে পীরের অনুসরণ করবে। তা আহার-নিদ্রাই হোক বা বস্তু পরিধান ও ইবাদত করাই হোক। পীর যেভাবে নামায পড়েন সেই ভাবে নামায পড়বে। তিনি শরীয়তের যে মত গ্রহণ করেন তুমি নিজেও তা গ্রহণ করবে। পীরের কোন গতিবিধির প্রতি সরিষা পরিমাণও সমালোচনা করবে না। যেহেতু সমালেচনাকারীর শেষ ফল বঞ্চিত হওয়া এবং এই বুজুর্গগণের ছিদ্রানুসন্ধানকারীই যাবতীয় সৃষ্টির মধ্যে দুর্ভাগ্যবান। স্বীয় পীরের কাছে কোন কারামত বা আলৌকিক ঘটনা দেখার আকাঙ্খা প্রকাশ করবে না। কোনও মুমিন ব্যক্তি স্বীয় পয়গম্বরের নিকট হতে কম্মিনকালেও মোজেজা দেখার আকাঙ্খা করেন নাই। বরং কাফের বা অস্বীকারকারীরা মোজেজা তলব করেছে। পীরের প্রতি যদি মুরিদের কোন সন্দেহের উদ্রেক হয়, তবে তা পীরের খেদমতে পেশ করবে। যদি তাঁর দ্বারা সেটার সামাধান না হয়, তবে নিজেরই ক্রটি বলে মনে করবে। পীরের প্রতি কোনরূপ দোষারোপ করবে না। যে কোন ঘটনা কিংবা স্বপ্ন যদি প্রকাশ পায়, তা পীর হতে গোপন রাখবে না। তাঁর নিকট হতে খোয়াবের তাবীর (স্বপ্নের ফলাফল) জানতে চাইবে এবং নিজের মনে যে তাবীর অনুমান হয়, তা তাঁর নিকট প্রকাশ করবে ও সত্যাসত্য জেনে নেবে। নিজের কাশফের কথা পীরের নিকট গোপন করবে না। নিজের কাশফের (আত্মিক বিকাশ) উপর মুরিদ কখনও নির্ভর করে কাজ করবে না। পীরের নিকট জিজ্ঞাসা করবে, কারণ এটি জগৎ এর সত্য-অসত্যের সাথে মিশ্রিত থাকে। বিনা কারণে বিনা আদেশে তাঁর নিকট হতে চলে যাবে না। অন্য লোককে পীর অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ জানা পীর ভক্তির বিরোধ কাজ, পীরের নিকট উচ্চ কন্ঠে কথা বলবে না, তাঁর আওয়াজ অপেক্ষা নিজের আওয়াজ উচ্চ করবে না, এটা অত্যন্ত বেআদবি। যে কোন ফায়েজ ও প্রসারণ আপন পীরের বদৌলতে হচ্ছে বুঝতে হবে। যদি মুরিদ স্বপ্নে দেখে যে অন্য পীর হতে ফায়েজ আসছে, তা অবশ্যই নিজের পীর হতে সমাগত বলে জানবে”।