মহান আল্লাহর পরিচয়

আল্লাহ আরবী শব্দ। পৃথিবীর কোন ভাষাতেই আল্লাহ শব্দের প্রতিশব্দ নেই। এমনকি আল্লাহ শব্দের কোন একবচন বা বহুবচনও হয় না। এ শব্দের কোন স্ত্রীলিঙ্গ বা পুংলিঙ্গও নেই। মূলত আল্লাহ শব্দটি একক এবং অতুলনীয়। মহান আল্লাহতায়ালাও তদ্রুপ । আল্লাহ এমন এক পবিত্র সত্তা যিনি এক, অদ্বিতীয়, অমুখাপেক্ষী এবং তাঁর সমকক্ষ কেউ নেই। তিনি পবিত্র কুরআনে বর্ণনা করেছেন,

قُل هُوَ اللَّهُ أَحَدُُ اللَّهُ الصَّمَُ لَم يَلِد وَلَم يولَدُ ُ وَلَم يَكُن لَهُ كُفُوًا أَحَدٌُ

অর্থ: ১. আপনি বলুন, তিনি আল্লাহ, তিনি এক, ২. আল্লাহ অন্যের মুখাপেক্ষী নন, ৩. না তাঁর কোন সন্তান আছে এবং না তিনি কারো থেকে জন্মগ্রহণ করেছেন, ৪. এবং না আছে কেউ তাঁর সমকক্ষ হবার। (সূরা ইখলাস, আয়াত-১,২,৩,৪)

আল্লাহতায়ালা স্বয়ংসম্পূর্ণ সত্তা। তিনি অনাদি, অনন্ত বা অসীম। তিনি চিরস্থায়ী ও সর্ববিরাজমান। আল্লাহর যেমন কোন শুরু-শেষ নেই তেমনি তিনি পানাহার, নিদ্রা, ক্লান্তি এসব কিছু থেকে মুক্ত। মহান আল্লাহ বলেন,

لَهُ مُلكُ السَّمٰوٰتِ وَالأَرضِ يُحيۦ وَيُميتُ وَهُوَ عَلىٰ كُلِّ شَيءٍ قَديرٌ ُ هُوَ الأَوَّلُ وَالءاخِرُ وَالظّٰهِرُ وَالباطِنُ وَهُوَ بِكُلِّ شَيءٍ عَليمٌ ُ هُوَ الَّذى خَلَقَ السَّمٰوٰتِ وَالأَرضَ فى سِتَّةِ أَيّامٍ ثُمَّ استَوىٰ عَلَى العَرشِ يَعلَمُ ما يَلِجُ فِى الأَرضِ وَما يَخرُجُ مِنها وَما يَنزِلُ مِنَ السَّماءِ وَما يَعرُجُ فيها وَهُوَ مَعَكُم أَينَ ما كُنتُم وَاللَّهُ بِما تَعمَلونَ بَصيرٌ ُ لَهُ مُلكُ السَّمٰوٰتِ وَالأَرضِ وَإِلَى اللَّهِ تُرجَعُ الأُمورُ يولِجُ الَّيلَ فِى النَّهارِ وَيولِجُ النَّهارَ فِى الَّيلِ وَهُوَ عَليمٌ بِذاتِ الصُّدورُِ

অর্থ: ২. তাঁরই (আল্লাহ) জন্য আসমানসমূহ ও যমীনের বাদশাহী; জীবন দান করেন আর মৃত্যু ঘটান। এবং তিনি সবকিছু করতে পারেন। ৩. তিনিই প্রথম, তিনিই শেষ, তিনিই প্রকাশ্য, তিনিই গোপন এবং তিনি সব কিছু জানেন। ৪. তিনিই, যিনি আসমানগুলো ও যমীনকে ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর আরশের ওপর সমাসীন হয়েছেন যেমনই তাঁর জন্য শোভা পায়। তিনি জানেন যা যমীনের মধ্যে প্রবেশ করে এবং যা তা থেকে বহির্গত হয়, আর যা আসমান থেকে অবতীর্ণ হয় এবং যা তাতে আরোহণ করে। আর তিনি তোমাদের সাথে আছেন তোমরা যেখানেই থাকো না কেন। এবং আল্লাহ তোমাদের কর্ম দেখছেন। ৫. তাঁরই- আসমানসমূহ ও যমীনের বাদশাহী এবং আল্লাহরই প্রতি সমস্ত কর্মের প্রত্যাবর্তন। ৬. রাতকে দিনের অংশে নিয়ে আসেন এবং দিনকে রাতের অংশে আনেন এবং তিনি অন্তরগুলোর কথা জানেন। (সূরা আল-হাদিদ, আয়াত-২,৩,৪,৫,৬)

মহান আল্লাহতায়ালা পাক কুরআনে বলেছেন,

اللَّهُ لا إِلٰهَ إِلّا هُوَ الحَىُّ القَيّومُ لا تَأخُذُهُ سِنَةٌ وَلا نَومٌ لَهُ ما فِى السَّمٰوٰتِ وَما فِى الأَرضُِ

অর্থ: তিনি আল্লাহ, যিনি ব্যতীত অন্য কোন উপাস্য নেই। তিনি নিজে জীবিত এবং অন্যান্যদের অধিষ্ঠিত রাখেন। তাঁকে না তন্দ্রা স্পর্শ করে, না নিদ্রা। তাঁরই, যা কিছু আসমানসমূহে রয়েছে এবং যা কিছু যমীনে। (সূরা বাকারা, আয়াত-২৫৫)

মহান আল্লাহ কোন দেশ বা সম্প্রদায়ের দেবতা নন, তিনি রাব্বুল আলামীন, নিখিল বিশ্বের প্রতিপালক। তিনি চির অবিনশ্বর নূর বা জ্যোতি। সাত আসমান-যমীনের তিনি অধীশ্বর। তাঁর সিংহাসন সকল সৃষ্টি এবং সময়কে পরিবেষ্টন করে আছে এবং তিনি অবতার রূপে কখনও জন্মগ্রহণ করেন না। তার পিতা, মাতা, স্ত্রী, পুত্র, কন্যা ইত্যাদি নাই।

বেদ, বেদান্ত, গীতা, উপনিষদ, বাইবেল ইত্যাদি আদি ধর্ম গ্রন্থে মহান আল্লাহর একত্ববাদ দ্ব্যর্থহীন ভাবে ঘোষিত হয়েছে। কিন্তু কালের আবর্তনে আল্লাহর একত্ববাদ বহুত্ববাদে পরিণত হয়েছে। পারস্যের আদিম জরদস্ত ধর্ম্মাবলম্বীগণ দ্বিত্ববাদী, খ্রিষ্টীয় ধর্ম্মাবলম্বীগণ তৃত্ববাদী এবং হিন্দুগণ সময়ের পরিক্রমায় বহুত্ববাদী হয়ে পড়েছে। আল্লাহর একত্ববাদের এ সকল বিশৃঙ্খলা লক্ষ্য করে পবিত্র কুরআনে আয়াত নাযিল হয়েছে-

وَقالَ اللَّهُ لا تَتَّخِذوا إِلٰهَينِ اثنَينِ إِنَّما هُوَ إِلٰهٌ وٰحِدٌ فَإِيّٰىَ فَارهَبونُِ

অর্থ: এবং আল্লাহ বলে দিয়েছেন, দুই আল্লাহ আছেন একথা বিশ্বাস করো না। আল্লাহ শুধুই একজন এবং কেবলমাত্র আমাকেই ভয় করো। (সূরা আন-নাহল, আয়াত-৫১)

খ্রিষ্টানদের মধ্যে “মারকূসিয়া ফেরকা” এ “নাসত্বুরিয়া ফেরকা” এর আক্বীদা হচ্ছে- “ইলাহ (উপাস্য) এর সংখ্যা তিনঃ পিতা, পুত্র ও রূহুল ক্বূদুস (পবিত্র আত্মা)”। আল্লাহকে পিতা, হযরত ঈসা (আঃ) কে তাঁর পুত্র আর হজরত জিবরাঈল (আঃ) কে রূহুল ক্বূূদূস বলে থাকে। কোন কোন খ্রিষ্টান হযরত মরিয়ম (রাঃ) কেই রূহুল ক্বূদুস এর পরিবর্তে খোদা বলে বিশ্বাস করে। তৃত্ববাদ এর অর্থ এটাই। এ সবে বিশ্বাসীরাই কাফের। এই প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেছেন,

لَقَد كَفَرَ الَّذينَ قالوا إِنَّ اللَّهَ ثالِثُ ثَلٰثَةٍ وَما مِن إِلٰهٍ إِلّا إِلٰهٌ وٰحِدٌ وَإِن لَم يَنتَهوا عَمّا يَقولونَ لَيَمَسَّنَّ الَّذينَ كَفَروا مِنهُم عَذابٌ أَليمٌُ

অর্থ: নিঃসন্দেহে কাফের ঐ সব লোক, যারা একথা বলে, “আল্লাহ তিন খোদার মধ্যে তৃতীয়” আর খোদা তো নেই, কিন্তু আছেন একমাত্র আল্লাহ; এবং যদি তারা যা বলে তা থেকে নিবৃত্ত না হয়, তবে তাদের মধ্যে যারা কাফের রূপে মৃত্যুবরণ করবে তাদের নিকট নিশ্চয় বেদনাদায়ক শাস্তি পৌঁছাবে। (সূরা মায়েদা, আয়াত-৭৩)

মহান আল্লাহ কুফরী থেকে নিবৃত্ত হয়ে এক আল্লাহর অনুগত হতে আহবান করে বলেছেন,

وَمِن ءايٰتِهِ الَّيلُ وَالنَّهارُ وَالشَّمسُ وَالقَمَرُ لا تَسجُدوا لِلشَّمسِ وَلا لِلقَمَرِ وَاسجُدوا لِلَّهِ الَّذى خَلَقَهُنَّ إِن كُنتُم إِيّاهُ تَعبُدونَ ُ

অর্থ: এবং তাঁরই (আল্লাহর) নিদর্শনসমূহের মধ্য থেকে রাত ও দিন, সূর্য ও চাঁদ; সেজদা করো না সূর্যকে এবং না চাঁদকে। এবং আল্লাহকে সেজদা করো, যিনি সেগুলো সৃষ্টি করেছেন, যদি তোমরা তার বান্দা হও। (সূরা হামিম, আয়াত-৭৩)

খাঁটি ইবাদতের জন্য মহান আল্লাহ সর্তক করে বলেছেন,

أَلا لِلَّهِ الدّينُ الخالِصُ وَالَّذينَ اتَّخَذوا مِن دونِهِ أَولِياءَ ما نَعبُدُهُم إِلّا لِيُقَرِّبونا إِلَى اللَّهِ زُلفىٰ إِنَّ اللَّهَ يَحكُمُ بَينَهُم فى ما هُم فيهِ يَختَلِفونَ إِنَّ اللَّهَ لا يَهدى مَن هُوَ كٰذِبٌ كَفّارٌُ

অর্থ: হ্যাঁ, অকৃত্রিম ইবাদত শুধু আল্লাহর জন্যই। এবং ঐ সব লোক, যারা তাঁকে (আল্লাহ) ব্যতীত অন্য অভিভাবক গ্রহণ করে বসেছে, তারা বলে, “আমরা তো তাদেরকে শুধু ততটুকু কথার জন্য পূজা করি যে, তারা আমাদেরকে আল্লাহর নৈকট্য এনে দেবে”। আল্লাহ তাদের বিচার করে দেখিয়ে দেবেন যে, যাতে তারা মতভেদ করেছে। নিশ্চয় আল্লাহ সৎ পথ প্রদান করেন না তাকে- যে মিথ্যাবাদী, বড় অকৃতজ্ঞ। (সূরা আয যুমায়, আয়াত-৩)

মহান আল্লাহ সকল বিষয়ে সর্বোৎকৃষ্ট গুণের অধিকারী। হাদিস শরীফে আল্লাহতায়ালার ৯৯টি গুণবাচক নামের কথা বলা রয়েছে। বস্তুতপক্ষে আল্লাহতায়ালার গুণবাচক নাম অসংখ্য। তার মধ্যে ৯৯টি নাম প্রসিদ্ধ ও বিখ্যাত। ইসলামী পরিভাষায় আল্লাহতায়ালার গুণবাচক নামসমূহকে একত্রে আসমাউল হুসনা বলা হয়। আসমাউল হুসনা শব্দদ্বয়ের অর্থ হলো সুন্দর নামসমূহ। এ সুন্দর নামসমূহ আল্লাহর পরিচয় ও ক্ষমতার প্রকাশ ঘটায়। এ নামগুলোর মাধ্যমে আল্লাহর গুণ ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানা যায়। এ সুন্দর নামসমূহের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম, কারণ এ নামগুলোর দ্বারা আমরা মহান আল্লাহকে ডাকতে পারি। স্বয়ং আল্লাহ পবিত্র কুরআনে তাঁর নামসমূহ ধরে তাঁকে ডাকতে বা প্রার্থনা করতে আদেশ করেছেন।

এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন,

وَلِلَّهِ الأَسماءُ الحُسنىٰ فَادعوهُ بِها وَذَرُوا الَّذينَ يُلحِدونَ فى أَسمٰئِهِ سَيُجزَونَ ما كانوا يَعمَلونَ ُ

অর্থ: এবং আল্লাহরই রয়েছে বহু উত্তম নাম, সুতরাং তোমরা তাঁকে ঔইসব নামে ডাকো এবং ঔইসব লোককে বর্জন করো, যারা তাঁর নামগুলোর মধ্যে সত্যের সীমা থেকে বেরিয়ে যায়। এবং তারা শীঘ্রই তাদের কৃতকর্মের ফল পাবে। (সূরা আল-আরাফ, আয়াত-১৮০)

আল্লাহতায়ালার গুণবাচক নামসমূহ মুসলমানদের উত্তম চরিত্রবান হতে অনুপ্রাণিত করে। আল্লাহর এসব গুণ অর্জনের মাধ্যমে সমাজে নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠিত হয়। সকল গুণ তাঁর মধ্যে পূর্ণ মাত্রায় আছে। তিনি সৃষ্টিকর্তা (খালিকু), তিনি রিযিকদাতা (রাজ্জাকু), তিনি সর্বশক্তিমান (কাবিয়্যু), তিনি পরম করুণাময় (রাহিমু), তিনি পরম ক্ষমাশীল (গাফফার), তিনি সর্বদ্রষ্টা (বাসির), তিনি সর্বশ্রোতা (সামিউ), তিনি তওবা গ্রহণকারী (তাওয়াবু), তিনি মহান (আলিউ), তিনি পরম দয়াময় (রাহমানু) ও স্নেহশীল (রাউফুল), তিনি হিসাব গ্রহণকারী (হাসিবুন), তিনি নিরাপত্তাদানকারী (মুমিনু), রক্ষণাবেক্ষণকারী (হাফিয্যু), আশ্রয়দাতা (মুহাইমিনুন)। বস্তুত আল্লাহতায়ালা তাঁর সত্তা ও গুণাবলিতে এক ও অতুলনীয়। তাঁর কোন অংশীদার নেই। সকল প্রশংসা তাঁরই জন্য, ইবাদতের যোগ্য সত্তা একমাত্র তিনিই। এ প্রসঙ্গে মুমিন মুসলমানদের দৃঢ় প্রতিজ্ঞার বর্ণনা পবিত্র কুরআনে এভাবে এসেছে-

صِبغَةَ اللَّهِ وَمَن أَحسَنُ مِنَ اللَّهِ صِبغَةً وَنَحنُ لَهُ عٰبِدونَ ُ

অর্থ: আমরা আল্লাহর রং গ্রহণ করেছি, এবং আল্লাহর রং অপেক্ষা কার রং অধিক উত্তম? আর আমরা তাঁরই ইবাদত করি। (সূরা বাকারা, আয়াত-১৩৮)

আল্লাহর রং হলো আল্লাহর দ্বীন ইসলামে উল্লিখিত ঈমান, যা কখনো নিশ্চিহ্ন হয়না। যে সব মানুষ নবী করিম (সাঃ)-এর নির্দেশিত পন্থায় ইসলাম গ্রহণ করেছেন বা ঈমান এনেছেন মূলত তারাই মহান আল্লাহর রঙে রাঙিয়েছেন নিজেদের, যে রং ইহকাল এবং পরকালে একটুও নষ্ট হয় না।

মহান আল্লাহ আমাদের আদি পিতা-মাতা আদম (আঃ) এবং হাওয়া (রাঃ)-এর মাধ্যমে পৃথিবীতে মানুষ আসার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন শুরু করেন। আমাদের আদি পিতা-মাতা থেকে এখন পর্যন্ত কোটি কোটি মানুষ পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেছেন এবং একটা নির্দিষ্ট সময় পর তারা মৃত্যুবরণ করে আল্লাহর কাছে ফিরেও গেছেন। পৃথিবীতে জন্ম নেওয়া সকল মানুষকে মহান আল্লাহ সরল পথ সুগম করার লক্ষ্যে প্রতিটি সম্প্রদায়ের জন্য নবী-রাসূল (আঃ) গণকে প্রেরণ করেছেন, এর মধ্যে সর্বপ্রথম নবী ছিলেন হযরত আদম (আঃ) আর সর্বশেষ নবী ও রাসুল হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)। এছাড়া এসেছেন অলি-আল্লাহ (রঃ) গণ। পবিত্র কুরআনে এভাবে এসেছে,

إِنّا أَرسَلنٰكَ بِالحَقِّ بَشيرًا وَنَذيرًا وَإِن مِن أُمَّةٍ إِلّا خَلا فيها نَذيرٌ ُ

অর্থ: এমন কোন সম্প্রদায় নেই যাদের কাছে আমি সতর্ককারী পাঠাইনি। (সূরা ফাতির, আয়াত-২৪)। মানুষ যেমন কেয়ামত পর্যন্ত জন্ম নেবে, আল্লাহর সঠিক-সরল পথের বাণী প্রচারের জন্যও তেমনি অলি-আল্লাহ আসতে থাকবেন সর্বশেষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ রাসুল হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর দ্বীন ইসলাম প্রচার এবং প্রসারের জন্য। রাসুল (সাঃ) বলেছেন, শুধু হক্কানী আলেমগণই বা অলি-আল্লাহগনই নবীর ওয়ারিশ বা প্রতিনিধি। (বুখারি, ইবনে মাজাহ, আহমদ ইবনে হাম্বল)

মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয় হাবীব রাসুল (সাঃ)-এর শান ও মান-মর্যাদা প্রকাশের জন্যই মানুষকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন তাঁর খলিফা বা প্রতিনিধি করে। হাদিসে কুদসীতে এসেছে, লাওলাকা লামা খালাক তুল আফলাক, অর্থ- তোমাকে সৃষ্টি না করলে আমি বিশ্বব্রম্মান্ড সৃষ্টি করতাম না। নবী করিম (সাঃ) আরো ইরশাদ করেন, আউয়ালু মা খালাকাল্লাহু নূরী, অর্থ- আল্লাহতায়ালা সর্বপ্রথম আমার নূর সৃষ্টি করেছেন। (মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক, বায়হাকি, দালালেলুন নবুয়ত)।

সৃষ্টির শুরু থেকে আজ পর্যন্ত শরীয়ত তথা দ্বীনের বিধি বিধান এক রকম ছিলনা। বরং মানবজাতির পরিবেশ, পরিস্থিতি, সভ্যতা-সংস্কৃতি ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে ভিন্ন ভিন্ন আসমানি কিতাব আল্লাহ নাযিল করেছেন। নবী-রাসুল (আঃ) এবং তাঁদের সিলসিলার অলি-আল্লাহ (রঃ) গণ তা মানব সমাজে প্রকাশ, প্রচার এবং বাস্তবায়ন করতেন। তবে সবার দ্বীনের মৌলিক কাঠামো ছিল এক ও অভিন্ন। আল্লাহতায়ালার একত্ববাদ ছিলো সবারই দ্বীনের মূলকথা। হযরত আদম (আঃ), হযরত নূহ (আঃ), হযরত ইব্রাহিম (আঃ), হযরত মুসা (আঃ), হযরত দাউদ (আঃ), হযরত ঈসা (আঃ) এবং হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) ও তাঁর অলি-আল্লাহ (রঃ) গণ সকলেই এই একই দ্বীন ও শিক্ষা প্রচার করেছেন। ইহুদি ধর্ম, খ্রিষ্ট্রান ধর্ম ও ইসলাম ধর্মের ভিন্ন ভিন্ন পথ থাকলেও তাদের সকলের উদ্দেশ্য খোদাপ্রাপ্তি। সুতরাং উদ্দেশ্যের দিক হতে সকল নবী-রাসুল (আঃ) এবং অলি-আল্লাহ (রঃ) গণ এক। তাই পথ ভিন্ন ভিন্ন হলেও উদ্দেশ্যের দিক হতে সব নবী-রাসুল (আঃ) ও অলি-আল্লাহ (রঃ) গণ এক। তাঁদের লিখিত বা অলিখিত বাণীর সঙ্গে আমরা কম-বেশী পরিচিত কিন্তু তাঁরা সকলেই আল্লাহর একত্ববাদের উপর বিশ্বাস রাখতেন এবং তাঁকে পাবার পথ দেখাতেন যুগে যুগে মানুষকে। এজন্য মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন,

قولوا ءامَنّا بِاللَّهِ وَما أُنزِلَ إِلَينا وَما أُنزِلَ إِلىٰ إِبرٰهۦمَ وَإِسمٰعيلَ وَإِسحٰقَ وَيَعقوبَ وَالأَسباطِ وَما أوتِىَ موسىٰ وَعيسىٰ وَما أوتِىَ النَّبِيّونَ مِن رَبِّهِم لا نُفَرِّقُ بَينَ أَحَدٍ مِنهُم وَنَحنُ لَهُ مُسلِمونَُ

অর্থ: তোমরা বলো, আমরা আল্লাহয় বিশ্বাস করি ও যা আমাদের উপর এবং ইব্রাহিম, ইসমাইল, ইয়াকুব ও তাঁর বংশধরদের উপর অবতীর্ণ হয়েছে, আর যা তাঁদের প্রতিপালকের কাছ থেকে ঈসা, মুসা ও অন্যান্য নবীদের দেয়া হয়েছিলো। আমরা তাঁদের মধ্যে কোন পার্থক্য করি না এবং আমরা তাঁর (আল্লাহর) কাছে আত্মসমর্পণ করি। (সুরা বাকারা, আয়াত-১৩৬)

এছাড়া সূরা বাকারার ২৮৫ নং আয়াতেও নবী-রাসুল (আঃ) গণের পার্থক্য না করার উল্লেখ আছে। মহান আল্লাহ বলেন,

لا نُفَرِّقُ بَينَ أَحَدٍ مِن رُسُلِهِ

অর্থ: তারা বলে, আমরা রাসুলগণের মধ্যে পার্থক্য করিনা। (সূরা বাকারা, আয়াত-২৮৫)। শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) ছিলেন নবুয়তের ধারার সর্বশেষ নবী এবং রাসুল। তাঁর পরে কোন নবী-রাসুল (আঃ) আর আসেননি এবং আসবেনও না।

মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেছেন,

اليَومَ أَكمَلتُ لَكُم دينَكُم وَأَتمَمتُ عَلَيكُم نِعمَتى وَرَضيتُ لَكُمُ الإِسلٰمَ دينًاُُ

অর্থ: আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং তোমাদের উপর আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম আর তোমাদের জন্য ইসলামকে দ্বীন মনোনীত করলাম। (সূরা মায়েদা, আয়াত-৩)

পরিশেষে একথা স্পষ্টরূপে প্রতিয়মান হয় যে, মহান আল্লাহ স্বর্গ, মর্ত্য এবং তার মধ্যস্থিত সকল বস্তুর সৃষ্টিকর্তা, প্রতিপালক এবং সংহারকর্তা। আল্লাহ এক, অদ্বিতীয় এবং সর্বত্র বিরাজমান। তিনি জন্ম দেন না, জন্মগ্রহণও করেন না এবং তাঁর সমতুল্য কেউ নেই। তিনি ক্ষুধা, তৃষ্ণা, কাম, ক্রোধ ইত্যাদি রিপু হতে মুক্ত। তিনি পবিত্র ও নির্দোষ। তিনি কাউকে স্ত্রীরূপে গ্রহণ করেন না এবং পুত্ররূপে জন্মগ্রহণ করেন না। তিনি ন্যায় বিচারক, একমাত্র উপাস্য, পরমদাতা, অপার করুণাময়, শান্তিÍদাতা, পরাক্রমশালী, গৌরবান্বিত এবং সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান। যদি জগৎ এর সৃষ্টিকর্তা একাধিক হতেন তবে প্রভাব বিস্তার বা একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারের জন্য তাদের মধ্যে এমন যুদ্ধ আরম্ভ হতো যে আসমান, যমীন এবং এর মধ্যস্থিত সকল কিছুই ধ্বংস হয়ে যেত। কিন্তু মহান আল্লাহ এক বলে সৃষ্টির শুরু থেকে সকল সৃষ্টি একই ভাবে বিরাজমান আছে এবং কেয়ামত পর্যন্ত একইভাবে থাকবে। এ জন্যই ইসলামের মূলমন্ত্র হয়েছে, “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ”।