মোজাদ্দেদ আলফেসানি (রঃ)-এর জন্ম, শৈশব এবং মোজাদ্দেদিয়া তরিকার উম্মেষ

নবীকুল শিরোমণি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর বিদায়ের হাজার বছর পর ১৪ শাওয়াল, ৯৭১ হিজরীতে সুবহে সাদেকের সময় ভারতের সেরহিন্দের এক নিভৃত গৃহে ভূমিষ্ঠ হয় এক মহাপবিত্র “নূর”, যার নাম রাখা হয় শায়েখ আহমদ (রঃ)। তিনিই হচ্ছেন তরিকতের শেষ ঈমাম হযরত আহমদ মোজাদ্দেদ আলফেসানি (রঃ)। তাঁর পূণ্যময়ী মা সন্তানের জন্মদানের সময় অজ্ঞান হয়ে পড়লে রূহানীভাবে দেখেন যে, রাসুল (সাঃ) সহ সকল নবী-রাসুল (আঃ) গণ, অলি-আল্লাহ (রঃ) গণ, ফেরেশতা (আঃ) গণ সত্তর হাজার নিশানসহ তার গৃহে তশরীফ এনেছেন। উপস্থিত সকলেই তার সন্তানের উচ্চ মর্যাদার কথা বর্ণনা করছেন। অন্যদিকে পিতা আব্দুল আহাদ (রঃ) সন্তানের জন্মের সময় দেখেন, রাসুল (সাঃ) সকল নবী (আঃ) গণ, সকল অলি-আল্লাহ (রঃ) গণ এবং অগণিত ফেরেশতা (আঃ) গণসহ তশরীফ এনেছেন। রাসুল (সাঃ) নবজাত শিশুকে মুবারকবাদ জানালেন ও স্বয়ং নবজাতকের কানে আজান ও একামত বললেন। হযরত শায়েখ আহমদ (রঃ) রাসুল (সাঃ)-এর মতো খৎনা অবস্থায় ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন। তিনি সাধারণ শিশুদের মতো ক্রন্দন করতেন না। তাঁর শরীর ও পোশাক-পরিচ্ছদ কখনও অপবিত্র হতো না।

মোজাদ্দেদ অর্থ নবায়নকারী, পূণর্জীবন দানকারী ও সংস্কারক। ইসলামী পরিভাষায় মোজাদ্দেদ হচ্ছেন মহান আল্লাহর নির্বাচিত এমন বান্দা যিনি রাসুল (সাঃ)-এর উত্তরাধিকারী হিসেবে দ্বীন ইসলামকে পূণর্জীবিত করেন। “আলফ” অর্থ হাজার আর সানি অর্থ দ্বিতীয়। শায়খ আহমদ (রঃ) হচ্ছেন দ্বিতীয় হাজার বছরের জন্য মোজাদ্দেদ, যার নূরের বরকতে কেয়ামত পর্যন্ত সত্য সন্ধানী মানুষ বেদাত-কুফরীর অন্ধকার হতে পরিত্রাণ পেতে থাকবে।

মহাপুরুষগণের আগমনের বার্তা আগে থেকেই ঘোষিত হতে থাকে। রাসুল (সাঃ)-এর আখেরী নবী হিসেবে আগমনের বার্তা যেমন পূর্ববর্তী নবী (আঃ) গণ বর্ণনা করেছিলেন তেমনি ভাবে মোজাদ্দেদ (রঃ)-এর আগমনের সংবাদও পূর্ববর্তী অলি-আল্লাহ (রঃ) গণ কর্তৃক বর্ণিত হয়েছিলো। স্বয়ং রাসুল (সাঃ) দ্বিতীয় হাজার বছরের মোজাদ্দেদের আবির্ভাবের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। রাসুল (সাঃ) ইরশাদ করেছেন, “হিজরী একাদশ শতাব্দীর শুরুতে মহান আল্লাহ এমন এক ব্যক্তিকে প্রেরণ করবেন যিনি এক বৃহৎ নূর! তাঁর নাম হবে আমার নামের অনুরূপ। দুই অত্যাচারী বাদশাহর মধ্যবর্তী সময়ে তিনি আবির্ভূত হবেন এবং তাঁর শাফাআতে অসংখ্য ব্যক্তি বেহেশতে প্রবেশ করবেন”। রওজাতুল কাইওমিয়া নামক গ্রন্থে এই হাদিস বর্ণিত আছে। এছাড়া আল্লামা সুয়্যূতী (রঃ) তাঁর জমাউলজমা গ্রন্থে একই হাদিস বর্ণনা করেছেন। এ হাদিসটি সম্পূর্ণরূপে হযরত মোজাদ্দেদ আলফেসানি (রঃ)-এর প্রতি প্রযোজ্য; যেহেতু তাঁর পবিত্র নাম “শায়েখ আহমদ” ছিল এবং তিনি একাদশ শতাব্দীর প্রথমে আকবর ও জাহাঙ্গীর দুই অত্যাচারী ইসলাম বিরোধী স¤্রাটের যুগে মোজাদ্দেদ হিসেবে প্রকাশিত হয়েছিলেন।

গাউসে পাক হযরত আব্দুল কাদের জিলানীও (রঃ) শায়খ আহমদ (রঃ)-এর আবির্ভাবের সংবাদ পূর্বেই জানতে পেরেছিলেন। একদিন গাউসে পাক (রঃ) কোন এক জঙ্গলে মোরাকাবায় বসলে হঠাৎ তাঁর সামনে এক অতি উজ্জ্বল নূরের আবির্ভাব হয়। সেই নূরের আলোয় সমস্ত পৃথিবী আলোকিত হয়ে ওঠে। তাঁর প্রতি এলহাম হলো- “তোমার পাঁচশ বছর পরে পৃথিবী শিরক-বেদাতের তমসায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়বে। সেই সময়ে রাসুল (সাঃ)-এর উম্মতের মধ্যে থেকে একজন অদ্বিতীয় অলি-আল্লাহ জন্মগ্রহণ করবেন এবং শিরক, বেদাত ও নাস্তিকতাকে ধ্বংস করবেন। স্পর্শমণিতুল্য হবে তাঁর সহবত। তাঁর সাহেবজাদা এবং খলিফাগণ আল্লাহর খাস দরবারের মেহমান হবে। এই এলহাম শুনে গাউসে পাক (রঃ) তাঁর খেরকা মুবারক বিশেষ কামালতে পূর্ণ করে সাহেবজাদা সৈয়দ তাজউদ্দিন আব্দুর রাজ্জাক (রঃ)-এর কাছে দিয়ে এ নির্দেশ দিয়ে যান যে, যখন সেই মহান বুজুর্গ-এর আতœপ্রকাশ হবে, তখন যেন এ খেরকা শরীফ তাঁকে পৌঁছে দেয়া হয়।

মাকামাতে শায়খুল ইসলাম আহমদ জামী (রঃ) তাঁর এক গ্রন্থে বলেছিলেন, আমার পরে আমার নামধারী সতের জন বুজুর্গ ব্যক্তির আবির্ভাব হবে, তাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি আসবেন আমার চারশ বছর পরে।

শায়েখ জলিলুল্লাহ বদ্খশানি তাঁর গ্রন্থে আফসোস করে বলেছিলেন, খাজেগানে নক্শবন্দিয়া সিলসিলায় হিন্দুস্থানে এক অদ্বিতীয় বুজুর্গ আসবেন এবং তাঁর সাথে দেখা হবার সৌভাগ্য না হওয়ার দরুন আমি বড়ই ব্যথিত থাকবো। তিনি হযরত মোজাদ্দেদ (রঃ) বরাবর একটি চিঠি লিখে যান এবং ১০২২ হিজরীতে সেই চিঠি হযরত মোজাদ্দেদ (রঃ)-এর নিকট পৌঁছে। চিঠিতে তিনি মোজাদ্দেদ (রঃ)-এর কাছে দোয়া চেয়েছিলেন।

এছাড়া শায়েখ জহুরউদ্দিন (কুঃ) তাঁর গ্রন্থে লিখেছেন, তাঁর পিতা আহমদ নেজাম (কুঃ) কে তাঁর মুরিদগণ মোজাদ্দেদ আলফেসানি (রঃ)-এর উচ্চ মর্যাদা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, আমার চারশ বছর পরে এক অসাধারণ বুজুর্গ ব্যক্তি আবির্ভূত হবেন। তাঁর অবস্থা আমার চেয়ে বহুগুণে উন্নত হবে এবং তিনি অতি উচ্চ মর্যাদাধারী হবেন।

মোজাদ্দেদ আলফেসানি (রঃ)-এর বুজুর্গ পিতা হযরত আব্দুল আহাদ (রঃ) একদা মোরাকাবায় বসে দেখেন, সমস্ত পৃথিবী তমসাচ্ছন্ন। হিং¯্র পশুরা মানব সম্প্রদায়কে আক্রমণ করছে এবং ক্ষত-বিক্ষত করছে। এ রকম অবস্থার মধ্যে তাঁর বাম সিনা মুবারক হতে এক অতি উজ্জ্বল নূর বের হয়ে তামাম পৃথিবীকে নূরান্বিত করে ফেললো। সেই নূরের তাজাল্লিতে হিং¯্র পশুকুল জ্বলে ভস্ম হয়ে গেলো। পুনরায় তিনি দেখলেন, সিংহাসনে উপবিষ্ঠ এক মহান বুজুর্গ। তার সামনে অসংখ্য নূরানী মানুষ এবং ফেরেশতা আদবের সাথে দাঁড়িয়ে আছে। সেই মহাপবিত্র বুজুর্গের সামনে জিন্দিক, নাস্তিক এবং জালেমদের পশুর মতো জবাই করা হচ্ছে।

শায়খ আব্দুল আহাদ (রঃ) এই মোরাকাবার ঘটনা তাঁর মুর্শিদ বিখ্যাত বুজুর্গ শাহ্ কামাল কায়থলী (রঃ)-এর কাছে বর্ণনা করেন। সব শুনে কায়থলী (রঃ) মহানন্দের সাথে জানান, “আপনার এক মহাপবিত্র পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করবেন। তিনি উম্মতে মুহাম্মদী (সাঃ)-এর মধ্যে সর্বোচ্চ মর্তবা সম্পন্ন অলি-আল্লাহ হবেন এবং তামাম পৃথিবী তাঁর নূরে নূরান্বিত হবে। তিনি দ্বীন ইসলামকে নতুন জীবন দান করবেন”।

এছাড়া নক্শবন্দিয়া তরিকতের ঈমাম হযরত খাজা বাহাউদ্দিন নক্শবন্দ (রঃ) নির্দেশ দিয়ে গিয়েছিলেন যে, হিন্দুস্থানে এ উচ্চ তরিকার নেসবত একজন মোজাদ্দেদ এর আবির্ভাব হলে তাঁর কাছে পৌঁছে দিতে হবে। তাঁর মাধ্যমে হযরত আবু বকর সিদ্দিকী (রাঃ) থেকে ক্রমাগত ভাবে চলে আসা নক্শবন্দিয়া তরিকার ব্যাপক প্রচার ও প্রসার হবে। সেই মহান মোজাদ্দেদের মাধ্যমে নেসবতে সিদ্দিকীর নূর পূর্ণরূপে বিকশিত হয়ে দোজাহান আলোকিত হবে। সেই মহান নির্দেশ সম্পাদনের সময় যখন উপনীত হলো তখন হযরত বাকীবিল্লাহ (রঃ) হিন্দুস্থান অভিমুখে রওনা হন তাঁর মুর্শিদ হযরত খওজগী আমকাংগী (রঃ)-এর আদেশে। লাহোরে তিনি যাত্রা স্থগিত করেন এবং এক বছর সেখানে থেকে নক্শবন্দিয়া তরিকার ব্যাপক প্রচার ও প্রসার করেন। এরপর তিনি দিল্লি অভিমুখে রওনা হয়ে পথিমধ্যে সেরহিন্দ শরীফের নিকট বিশ্রাম নেবার জন্য থামেন। সেখানে অবস্থানকালে রাতে স্বপ্নে দেখেন, একটি বৃহৎ প্রদীপ তিনি প্রজ্জ্বলন করে দিলেন এবং সেই প্রদীপ থেকে অনেক লোক নিজেদের প্রদীপ জ্বালিয়ে নিচ্ছেন। যখন তিনি সেরহিন্দ শরীফের কাছে গিয়ে হাজির হলেন, দেখলেন মাঠে ময়দানে এবং জঙ্গলে অসংখ্য প্রদীপ জ্বলছে। এই বৃহৎ প্রদীপই মোজাদ্দেদ আলফেসানি (রঃ)।

হযরত মোজাদ্দেদ আলফেসানি (রঃ) ছিলেন ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর বিন খাত্তাব (রাঃ)-এর বংশধর। তার বংশধর সাতাশ পুরুষে যেয়ে ওমর (রাঃ)-এর সাথে মিলিত হয়। হযরত ওমর (রাঃ)-এর পুত্র বিখ্যাত সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ (রাঃ) ঈমাম হাসান (আঃ)-এর কন্যা ফাতেমা (রাঃ) কে বিয়ে করেন। তাঁদেরই বংশে হযরত শায়েখ আহমদ (রঃ)-এর জন্ম। এজন্য তিনি পিতার দিক হতে ফারূকী এবং মাতার দিক হতে সৈয়দ ছিলেন।

শৈশবকালে মোজাদ্দেদ আলফেসানি (রঃ) একবার অসুস্থ হয়ে পড়লে হযরত শাহ্ কামাল কায়থলী (রঃ) তাঁকে দেখতে আসেন। হযরত শাহ কামাল (রঃ) তাঁকে দেখেই আনন্দে অধীর হয়ে উঠেন এবং বলেন, “মহান আল্লাহ এ শিশুর হায়াত দারাজ করুন। ইনি একজন খাঁটি আলেম ও আরেফে কামেল হবেন। আমাদের মতো বুজুর্গগণ তাঁর কোলে প্রতিপালিত হবে এবং অশেষ উপকার লাভ করবে। কেয়ামত পর্যন্ত তাঁর নূর সমুজ্জ্বল থাকবে। বহু অলি-আল্লাহ তাঁর আগমনের সুসংবাদ দিয়ে গেছেন। বহু বুজুর্গ তাঁর আবির্ভাবের প্রতীক্ষায় পথ চেয়ে আছেন”।

বিদায়ের আগ দিয়ে হযরত কায়থলী (রঃ) ¯েœহবশত তাঁর জিহŸা মুবারক শিশু শায়েখ আহমদ (রঃ) এর মুখে প্রবেশ করান। শায়েখ আহমদ (রঃ) তাঁর জিহŸা মুবারক সজোরে চুষতে আরম্ভ করেন। তখন হযরত শাহ্ কামাল কায়থলী (রঃ) বলেন, “এই মুবারক শিশু এবার কাদেরিয়া তরিকার সকল কামালত হাসিল করলেন”।

সময়ের পরিক্রমায় যখন মোজাদ্দেদ আলফেসানি (রঃ) জ্ঞান আহরণের দিকে মনোনিবেশ করেন, সর্বপ্রথমে তিনি পবিত্র কুরআন মজিদ হেফজ করা শুরু করেন একটি মক্তবে ভর্তি হয়ে এবং অল্প দিনের মধ্যেই তিনি পূর্ণ হাফেজ হয়ে যান। তাঁর বিদ্যা শিক্ষায় শিয়ালকোটের বিশিষ্ট আলেম মওলানা কামাল উদ্দিন, কাজী বহলুল বদখ্শানী এবং কাশ্মীরের মোহাদ্দেস শায়েখ ইয়াকুবের ভূমিকা অগ্রগণ্য। মাত্র সতের বছর বয়সে তাঁর বিদ্যা শিক্ষা সমাপ্ত হয় এবং তাঁর সুনাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে যে, তিনি মোহাদ্দেসের আসনে উপবিষ্ট হয়েছেন। এরপর তিনি শিক্ষাদান কার্য শুরু করলে দেশ-বিদেশের শিক্ষার্থীগণ দলে দলে তাঁর কাছে আসতে থাকে এবং শিক্ষা শেষ করে বহু মানুষ তাঁর থেকে সনদ লাভ করেন।

এরপর তিনি তাঁর বুজুর্গ পিতা শায়েখ আব্দুল আহাদ (রঃ)-এর নিকট মুরিদ হয়ে মারেফত সাধনা শুরু করেন। তাঁর বুজুর্গ পিতা শায়েখ আব্দুল আহাদ (রঃ) মারেফত অর্জন করেন তৎকালীন বিখ্যাত বুজুর্গ হযরত আবদুল কুদ্দুস গাঙ্গুহী (রঃ), শায়েখ রুকুনুদ্দিন (রঃ), শাহ্ কামাল কায়থলী (রঃ) সহ আরো অনেক মাশায়েখ (রঃ) হতে। তিনি হিজরী ৯৭৯ সালে কাদেরিয়া ও চিশ্তিয়া সাবেরীয়া তরিকার খেরকা ও খেলাফত অর্জন করেন হযরত গাঙ্গুহী (রঃ)-এর পুত্র হযরত রুকুনুদ্দিন (রঃ)-এর নিকট থেকে। মোজাদ্দেদ আলফেসানি (রঃ) তাঁর পিতা শায়েখ আহাদ (রঃ)-এর ওসিলায় কঠোর সাধনার ফলে মহান আল্লাহর খাস রহমতে অতি অল্প দিনের মধ্যে সরওয়ার্দিয়া, কাদেরিয়া ও চিশ্তিয়া তরিকার খেরকা ও খেলাফতসহ একে একে পনেরটি তরিকার খেলাফত হাসিল করেন। এছাড়া তাঁর পিতা কায়থলী (রঃ)-এর নিকট থেকে চিশ্তিয়া খানদানের যে ফরদিয়াতের নেসবত হাসিল করেছিলেন তাও তিনি লাভ করেন।

শায়েখ আহমদ (রঃ) যৌবনে পদার্পণ করলে রাসুল (সাঃ)-এর নির্দেশে বিবাহের সুন্নত সুসম্পন্ন হয়। রাসুল (সাঃ) নিজেই শায়খ আহমদ (রঃ)-এর স্ত্রী নির্ধারণ করে দেন। থানেশ্বরের শাসনকর্তা শায়েখ সুলতানকে তিনি পরপর তিনবার শায়েখ আহমদ (রঃ)-এর সাথে তার কন্যার বিবাহ দেবার নির্দেশ দেন। তাঁর স্ত্রী অত্যন্ত পূণ্যবতী মহিলা ছিলেন। বিয়ের পর তাঁর আর্থিক অবস্থা সচ্ছলতার দিকে যেতে থাকে এবং তিনি বসবাসের জন্য নতুন একটি বাড়ী তৈরি করেন।

শায়েখ আহমদ (রঃ) পিতা শায়েখ আব্দুল আহাদ (রঃ) কর্তৃক নক্শবন্দিয়া তরিকার উচ্চ মর্তবা সম্পর্কে জানতে পেরেছিলেন। কামালতে নবুয়তের সাথে সম্পর্কিত অতি উচ্চ সূক্ষাতিসূক্ষ মারেফতসমূহ নক্শবন্দিয়া আউলিয়া-বুজুর্গগণের হাতে আছে। কিন্তু তৎকালীন সময় হিন্দুস্থানে নক্শবন্দিয়া তরিকার কোন বুজুর্গ না থাকার আফসোস তাঁর পিতা প্রায়ই করতেন। তাঁর নিজের হৃদয়েও নক্শবন্দিয়া তরিকা সম্পর্কে জানার আগ্রহ দিন দিন বর্ধিত হতে লাগলো। এই আফসোস নিয়েই ১০০৭ হিজরীর ১৭ রজব আশি বছর বয়সে শায়েখ আব্দুল আহাদ (রঃ)- এর ওফাত হয়ে যায়।

সাধনার পথ সরল ও নিয়মাবলী সহজসাধ্য না হলে বর্তমান যুগে সাধনায় উন্নতি লাভ করা অত্যন্ত কঠিন। পূর্ব যুগের সাধকগণ অনেক বেশী সুস্থ, কষ্টসহিষ্ণু, দীর্ঘজীবী ও একাগ্রচিত্ত ছিলেন। সাধনার সুদীর্ঘ পথ অবলোকন করে তাঁরা পিছুপা হন নাই কখনোই। পক্ষান্তরে বর্তমান জামানার মানুষ একেবারে দুর্বল ও স্বল্পায়ু এবং এরা পূর্বের মানুষের মতো এতটা একাগ্রচিত্ত ও অধ্যবসায়ীও নয়। তাই শেষ যুগের মুসলমানদের সাধনার পথে সাফল্য নিয়ে নবীকুল শিরোমণি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) অনেক ভাবাগোনা করতেন। প্রায়ই বিব্রত হয়ে অশ্রæপাত করতেন আর তাদের কল্যাণের উদ্দেশ্যে মহান আল্লাহর কাছে বিনীতভাবে প্রার্থনা করতেন।

সময়ের পরিক্রমায় ঈমামুত তরিকত হযরত খাজা বাহাউদ্দিন নক্শবন্দ (রঃ) ৫০ জন কামেল আউলিয়াসহ ১৫ দিন সেজদায় পড়ে অত্যাধিক ক্রন্দন করেছিলেন। ভক্তের ক্রন্দনে মহান আল্লাহর আরশ কাঁপতে থাকে। মহা পরাক্রমশালী এবং দয়ালু আল্লাহ সদয় হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “প্রিয়বর! কি চাও বল? আমি তোমার প্রার্থনা মঞ্জুর করবো”। মানুষের কল্যাণের চিন্তায় বিভোর মহাসাধক খাজা বাহাউদ্দিন নক্শবন্দ (রঃ) তখন আরজ করলেন, “প্রভু! এ যুগের মানুষ একেবারে দুর্বল ও অল্প আয়ু। তুমি এদের জন্য এমন একটি তরিকা প্রদর্শন করো যা এ যুগের সাধকের পক্ষে সহজসাধ্য ও কল্যাণকর হয়”। দয়াময় খোদা তাঁর প্রার্থনা মঞ্জুর করলেন এবং একটি সহজ পথ প্রদর্শন করলেন। এ পথ বা তরিকার নাম নক্শবন্দিয়া। এই তরিকায় অল্প সাধনায় অভূতপূর্ব উন্নতি সাধিত হয় সাধকের।

মোজাদ্দেদ আলফেসানি (রঃ) মকতুবাত শরীফের প্রথম খন্ডের প্রথম ভাগের ৫৮ মকতুবাদে বলেছেন, “অন্যান্য তরিকার শেষে যা অর্জিত হয়, নক্শবন্দিয়া তরিকায় প্রারম্ভেই তা সাধকের মধ্যে প্রবেশ করানো হয়। এ তরিকা আল্লাহর অতি নিকটবর্তী তরিকা। এ বুজুর্গগণের তরিকা অবিকল সাহাবা কেরাম (রাঃ)-এর তরিকা। সাহাবাগণ রাসুল (সাঃ)-এর প্রথম সহবতেই যা পেয়েছিলেন, অলি-আল্লাহগণের অনেকেই হয়তো শেষ মাকামেও তা লাভ করতে পারেনা। এজন্য অহশী (রাঃ) নামক সাহাবী যিনি হযরত হাম্জা (রাঃ) কে শহীদ করেছিলেন এবং যিনি সাহাবীদের মধ্যে নি¤œতম মর্তবাধারী, তিনিও ওয়ায়েছ করনী (রঃ) হতে উৎকৃষ্ট। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক জিজ্ঞাসিত হয়েছিলেন যে, মোয়াবিয়া এবং ওমর ইবনে আব্দুল আজিজ এই উভয়ের মধ্যে কে উৎকৃষ্ট? তদুত্তরে তিনি বলেছিলেন, হযরত রাসুল (সাঃ)-এর অনুগমনকালে মোয়াবিয়ার অশ্বের নাসারন্ধ্রে যে ধূলিকণা প্রবিষ্ট হয়েছিলো, তাও ওমর ইবনে আব্দুল আজিজ হতে বহুগুণ মর্যাদাশীল। অতএব চিন্তা করে দেখা উচিত, যাদের প্রারম্ভেই অন্যদের শেষ তাদের শেষ যে কি হবে তা অন্যে কি আর বুঝবে! “তদীয় প্রতিপালকের সৈন্যের খবর তিনি ব্যতীত কেউই জানেন না। (কুরআন)”।

সুতরাং এ কথা স্পষ্টরূপে বলা যায়, নক্শবন্দি বুজুর্গগণের সিলসিলা যেন সোনার সিলসিলা এবং অন্য তরিকা হতে এ তরিকার শ্রেষ্ঠত্ব ঐরূপ, অন্য জামানা হতে সাহাবা (রাঃ) গণের জামানার শ্রেষ্ঠত্ব যেরূপ। সাহাবা কেরাম (রাঃ) গণের নেসবত আর অন্য অলি-আল্লাহ (রঃ) গণের নেসবতের ব্যবধান এতটা যে একজন সাহাবা (রাঃ)- এর পদধুলির সমান কোন অলি-আল্লাহ (রঃ) নন। তদ্রæপ সাহাবা কেরাম (রাঃ) গণের তরিকার সাথে অন্য অলি-আল্লাহ (রঃ) গণের তরিকার যেমন ব্যবধান, নক্শবন্দি তরিকার সাথে অন্য তরিকার ঐরূপ ব্যবধান।

নক্শবন্দিয়া তরিকা কামালতে নবুয়তের সাথে সম্পর্কিত। এ সম্পর্কে হযরত মোজাদ্দেদ আলফেসানি (রঃ) মকতুবাত শরীফের ১ম খন্ড ৩য় ভাগের ২৮১ মকতুবাতে বলেছেন, “এ ফকিরের নিকট এই তরিকার এক পদ অগ্রসর হওয়া অন্য তরিকার সাত পদ অগ্রসর হওয়া হতেও উৎকৃষ্ট। কামালতে নবুয়ত পর্যন্ত এবং উত্তরাধিকারী হিসেবে পথ খুলে দেয়া এই উচ্চ তরিকারই বৈশিষ্ট্য। কামালতে বেলায়েতের শেষ মর্তবা পর্যন্ত অন্য তরিকার শেষ, তা হতে তাদের কামালতে নবুয়ত পর্যন্ত কোনই পথ খুলে দেয়া হয়না”।

হযরত বাকীবিল্লাহ (রঃ) লাহোর থেকে সেরহিন্দ শরীফ হয়ে দিল্লি পৌঁছেন এ নক্শবন্দিয়া তরিকা তাঁর উত্তরাধিকারের কাছে পৌঁছে দেবার চূড়ান্ত লক্ষ্য নিয়ে। দিল্লিতে ফিরোজী কেল্লায় বসবাসের জন্য স্থান নির্ধারণ করেন। বাস করার জন্য তিনি খুবই ছোট এবং জরাজীর্ণ ঘর প্রস্তুত করেন। দুনিয়ার প্রতি তাঁর কোন মোহ ছিল না। তার মজলিসেও কেউ দুনিয়ার কোন আলাপ-আলোচনা করতে পারতো না। ক্রমে ক্রমে চারিদিকে নক্শবন্দিয়া তরিকার সৌরভ ছড়িয়ে পড়লে দলে দলে সাধারণ মানুষ ছাড়াও অধিকাংশ মাশায়েখ ও পীরানে কেরাম পীর-মুরিদি ছেড়ে হযরত বাকীবিল্লাহ (রঃ)-এর খেদমতে হাজির হয়ে নক্শবন্দি নেয়ামত দ্বারা নিজেদের সম্মানিত করতে থাকেন।

অন্যদিকে হযরত মোজাদ্দেদ আলফেসানি (রঃ) হজ ও রাসুল (সাঃ)-এর রওজা মুবারক যিয়ারতের জন্য রওনা হন। বৃদ্ধ ও অসুস্থ পিতা শায়েখ আব্দুল আহাদ (রঃ)-এর খেদমতে নিয়োজিত থাকার জন্য তিনি মক্কা শরীফ ও মদীনা মনওয়ারা সফর স্থগিত রেখেছিলেন এতদিন। প্রথমে তিনি দিল্লি আসেন এবং তাঁর বন্ধু মওলানা হাসান কাশ্মীরি (রঃ)-এর মেহমান হন। হযরত কাশ্মীরি (রঃ) তাঁকে জানান, দিল্লিতে একজন নক্শবন্দি বুজুর্গের আগমন হয়েছে, যিনি নক্শবন্দিয়া তরিকার এক অমূল্য রতœ। এরকম ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন বুজুর্গ বর্তমান জামানায় দূর্লভ। দীর্ঘদিন রিয়াজত ও চিল্লাকশিতে যা অর্জন করা যায়না, তাঁর এক তাওয়াজ্জোহ এর বরকতে মূহুর্তে তা হাসিল হয়ে যায়।

শায়েখ আহমদ (রঃ)-এর অন্তরে উপরোক্ত সংবাদ জেনে প্রবল ব্যাকুলতা সৃষ্টি হয় এবং তিনি আর দেরী না করে হযরত বাকীবিল্লাহ (রঃ)-এর খেদমতে দরবার শরীফে হাজির হন। অবাক হয়ে দেখেন ক্ষীণকায় দূর্বল এই নক্শবন্দি বুজুর্গ এর চেহারা মুবারক। এ যেন জ্বলন্ত এক নূরস্ফুলিঙ্গ, মহান আল্লাহর এক বিরল নিদর্শন।

খাজা বাকীবিল্লাহ (রঃ) তাঁর প্রতি দৃষ্টিপাত করলেন। দেখেই চিনতে পারলেন এই সেই সৌভাগ্যবান ব্যক্তি যার জন্য নেসবতে সিদ্দিকী (রাঃ)-এর আমানত সিলসিলা মারফত চলে আসছে। এই সেই রাসুল (সাঃ)-এর খাস প্রতিনিধি যার জন্য তাঁকে হিন্দুস্থানে আগমন করতে হয়েছে। করো প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করা ছিল হযরত খাজা (রঃ)-এর স্বভাব বিরুদ্ধ। কিন্তু তিনি শায়েখ আহমদ (রঃ)-এর ব্যাপারে যথেষ্ট আগ্রহ দেখান এবং বলেন, “আপনি আমার খানকায় কিছুদিন অবস্থান করুন”।

শায়েখ আহমদ (রঃ) এক সপ্তাহ অবস্থান করার ওয়াদা করেন। দুই দিন পার না হতেই তাঁর হালত পরিবর্তন হয়ে গেলো। হযরত খাজা (রঃ)-এর জজবায় তিনি প্রভাবান্বিত হতে থাকলেন। নক্শবন্দিয়া তরিকা গ্রহণের আকাঙ্খা তাঁর মধ্যে চরমভাবে আলোড়ন সৃষ্টি করলো। তিনি হযরত খাজা (রঃ)-এর কাছে বায়আত হবার আর্জি পেশ করলেন। তিনি শায়েখ আহমদ (রঃ) কে নিভৃত স্থানে ডেকে বায়আত করে মুরিদ বানালেন। শায়েখ আহমদ (রঃ) নক্শবন্দিয়া তরিকার উচ্চস্তর গুলো একে একে হাসিল করে মাত্র দুই মাস কয়েকদিনের মধ্যে চূড়ান্ত স্তরে উপনীত হন হযরত খাজা (রঃ)-এর খাস তাওয়াজ্জোহে। তিনি তাঁর অবস্থা হযরত খাজা (রঃ) কে জানালে তিনি বলেন, “আপনার মধ্যে মাহবুবিয়াত ও মোরাদিয়াত এর নেসবত আছে। মুহিব্বিয়াত ও মুরিদিয়াত ব্যক্তিদের তুলনায় এইরূপ নেসবতধারী ব্যক্তিগণ অনায়াসে সুলুকের সমস্ত স্তর অতিক্রম করতে পারেন”। তিনি নিজে তাঁর প্রাথমিক অবস্থা মকতুবাত শরীফ ১ম খন্ডের ২৯০ নং মকতুবে বর্ণনা করেছেন।

হযরত খাজা (রঃ) শায়েখ আহমদ (রঃ)-এর যোগ্যতা দেখে মুগ্ধ হয়ে তাঁর এক বন্ধুর কাছে লেখেন, “শায়েখ আহমদ সেরহিন্দ শরীফের একজন খ্যাতিমান বুজুর্গ। তিনি বিদ্ধান ও বা-আমল আলেম। ফকির কয়েকদিন মাত্র তাঁর সহবতে আছেন। এতেই তিনি বিস্ময়কর ও দুর্লভ অবস্থা লাভ করেছেন। তিনি একটি বৃহৎ নূর যা একদিন সমগ্র পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে। আলহামদুলিল্লাহ। ফকিরের বিশ্বাস ও কামালত তাঁর মধ্যে স্থিতিবান হয়েছে। ফকিরগণের অন্তর আল্লাহ প্রাপ্তির দরজা”।

হযরত খাজা (রঃ)-এর দরবারে মুরিদগণ তাদের জ্ঞান অনুযায়ী তাঁর প্রতি পৃথক পৃথক আকিদা রাখতেন এবং সেই অনুপাতে ফায়েজ পেতেন। কিন্তু শায়েখ আহমদ (রঃ)-এর আকিদা ছিল সর্বোচ্চ এবং তিনি বিশ্বাস করতেন, রাসুল (সাঃ)-এর পর হযরত খাজা (রঃ)-এর মত তরবিয়ত আর কারো নসিব হয়নি।

শায়েখ আহমদ (রঃ)-এর পীর ভাই শায়েখ তাজ সাম্ভলী (রঃ)-এর দায়িত্ব ছিল সব মুরিদের হাল শুনে হযরত খাজা (রঃ)-এর নিকট জানানো। কিন্তু শায়েখ আহমদ (রঃ) ছিলেন এর ব্যতিক্রম। হযরত খাজা (রঃ)-এর তাঁর প্রতি আদেশ ছিলো নিজের অবস্থা সরাসরি তাকে জানানো। কিন্তু আদব প্রদর্শনের জন্য অধিকাংশ সময় শায়েখ আহমদ (রঃ) নীরব থাকতেন।

হঠাৎ একদিন শায়েখ আহমদ (রঃ) কি মনে করে শায়েখ তাজ (রঃ)-এর দিকে খেয়াল করলেন এবং তাওয়াজ্জোহ দিলেন, সঙ্গে সঙ্গে তিনি জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে গেলেন। হযরত খাজা (রঃ) শায়েখ আহমদ (রঃ) কে বারবার এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি খুলে বলেন। সব শুনে হযরত খাজা (রঃ)-এর চেহারা মুবারক বিবর্ণ হয়ে যায়। উপস্থিত অন্যান্য ব্যক্তিবর্গও শায়েখ আহমদ (রঃ)-এর উচ্চস্তর অনুধাবন করে হতবিহŸল হয়ে পড়েন।

শায়েখ আহমদ (রঃ) নক্শবন্দিয়া তরিকার পূর্ণ কামালত হাসিল হয়ে যাবার পর হযরত খাজা (রঃ) তাঁকে নক্শবন্দিয়া তরিকার খেলাফতনামা প্রদান করেন এবং সেরহিন্দ শরীফে যাবার আদেশ করেন। তাঁর মতো মাহবুব ও মোরাদ ব্যক্তির তরবিয়তের সুযোগ লাভের জন্য হযরত খাজা (রঃ) মহান আল্লাহর দরবারে শোকরানা আদায় করলেন।

শায়েখ আহমদ (রঃ) সেরহিন্দ শরীফে ফিরে এসে মুর্শিদের নির্দেশ অনুযায়ী নেসবতে সিদ্দিকীর নক্শবন্দিয়া তরিকার নূর চারিদিকে ছড়িয়ে দিতে তৎপর হয়ে পড়েন। এ মহাপবিত্র দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে তিনি শত শত সাধককে কামালিয়াতের উচ্চস্তরে পৌঁছে দিয়েছিলেন। ব্যস্ততার মধ্যে দিয়ে তাঁর দিন যাচ্ছিল। এর মধ্যে প্রিয় মুর্শিদকে দর্শনের আকাঙ্খা তাঁর ভেতর তীব্র রূপ ধারণ করে। তিনি দিল্লি অভিমুখে রওনা হলেন।

হযরত খাজা বাকীবিল্লাহ (রঃ) প্রিয়তম খলিফার আগমনের সংবাদ পেয়ে সমস্ত খাদেম ও সালেকগণকে সঙ্গে নিয়ে শায়েখ আহমদ (রঃ) কে স্বাগত জানাতে দিল্লির কাবুলী দরজা পর্যন্ত গিয়ে হাজির হন। সেখান থেকে অতিশয় সম্মান প্রদর্শনপূর্বক তাঁকে সঙ্গে নিয়ে দরবার শরীফে ফিরে আসেন।

এবার শায়েখ আহমদ (রঃ)-এর অন্যরূপ অবস্থার সৃষ্টি হলো। তাঁর প্রতি বিশেষ কামালতের ফয়েজ বর্ষিত হতে লাগলো এবং যেসব বিচিত্র ও গূঢ় মারেফতের রহস্যাদি প্রকাশিত হতে লাগলো যে তা দেখে হযরত খাজা (রঃ) বিস্মিত হয়ে গেলেন। তিনি আর ওস্তাদ থাকলেন না, শিষ্য হয়ে গেলেন। হযরত শায়েখ আহমদ (রঃ)-এর নিকট থেকে তিনি উচ্চস্তরের দুর্লভ মারেফত সমূহের বর্ণনা ছাত্রের মতো গ্রহণ করতে লাগলেন।

পরিস্থিতির এমন পরিবর্তন অবলোকন করে হযরত খাজা (রঃ)-এর খলিফা ও মুরিদগণ বিস্ময়ে হতবিহŸল হয়ে পড়েন। কেউ কেউ হযরত শায়েখ আহমদ (রঃ) এর প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করতে লাগলেন এবং হযরত খাজা (রঃ) কুওতে বাতেনী দ্বারা সব কিছু জানতে পেরে খুবই রাগান্বিত হয়ে পড়েন। হযরত খাজা (রঃ) সবাইকে সতর্ক করে বলেন, “তোমরা যদি নিজেদের ঈমান বাঁচাতে চাও তবে হযরত শায়েখ আহমেদের প্রতি উত্তম আকিদা রাখ এবং আদব প্রদর্শন কর। কারণ তিনি রূহানী জগৎ এর এমন এক তেজষ্কর সূর্য, যার উদয়ে আমাদের মতো শত সহ¯্র নক্ষত্র জ্যোতিহীন হয়ে পড়েছে। স্মরণ রাখ উম্মতে মুহাম্মদীর মধ্যে যে চারজন শ্রেষ্ঠ আউলিয়া আছেন তিনি তাদের অন্যতম”।

কখনও কখনও হযরত খাজা (রঃ) তাঁর অধীনে নিজের সকল খলিফা ও মুরিদসহ মোরাকাবায় বসে ফয়েজ হাসিল করতে লাগলেন। ফেরার সময় বড়ই আদবের সাথে ফিরে আসতেন। কোন ক্রমেই শায়েখ আহমদ (রঃ)-এর প্রতি কেউ পৃষ্ঠ প্রদর্শন করতেন না।

হযরত খাজা (রঃ)-এর এমন সম্মান প্রদর্শন দেখে হযরত শায়েখ আহমদ (রঃ) লজ্জিত হয়ে পড়েন। একদিন তিনি অত্যন্ত আদব সহকারে হযরত খাজা (রঃ)-এর নিকট আরজ করলেন, “এই নিকৃষ্ট গোলামের প্রতি হুজুর যেরূপ আদব ও সম্মান প্রদর্শন করছেন তাতে আমি বড়ই লজ্জিত ও অনুতপ্ত”।

হযরত খাজা (রঃ) অস্থির ভাবে জবাব দিলেন, “আল্লাহর আদেশ ছাড়া আমি কিছুই করছি না। গায়েব হতে এরূপ করার জন্য আমাকে আদেশ দেয়া হয়েছে এবং এ পালন করতে আমি বাধ্য”।

এভাবে চলতে চলতে হযরত শায়েখ আহমদ (রঃ)-এর সেরহিন্দ শরীফে প্রত্যাবর্তনের সময় এসে পড়লো। হযরত খাজা (রঃ) তাঁর যাবতীয় বাতেনী নিয়ামত ও কামালিয়াত প্রিয় শিষ্যকে দান করলেন এবং এরশাদের তাজ তাঁর মাথা মুবারকে পরিয়ে দিলেন। হযরত খাজা (রঃ)-এর নির্দেশে তাঁর সমস্ত খলিফাগণের হেদায়েত ও মুরিদগণের তরবিয়তের ভারও তাঁকে গ্রহণ করতে হলো।

হযরত শায়েখ আহমদ (রঃ) সেরহিন্দ শরীফে ফিরে এসে শত সহ¯্র সালেককে তিনি নক্শবন্দিয়া তরিকার নূরে নূরান্বিত করতে থাকেন তাঁর স্পর্শমণিতুল্য সহবত দ্বারা। দীর্ঘদিন তিনি স্বদেশে এ মহাপবিত্র কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন।

হিজরী ১০১০ সালের ১০ রবিউল আউয়াল শুক্রবার সোবহে সাদেকের লগ্ন। হযরত শায়েখ আহমদ (রঃ) নির্জন কক্ষে ধ্যানরত। এমন সময় মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) তশরীফ আনলেন। সঙ্গে সকল নবী-রাসুল (আঃ), আউলিয়া কেরাম (রঃ) এবং অসংখ্য ফেরেশতা (আঃ)। রাসুল (সাঃ) তাঁর পবিত্র হাতে হযরত শায়েখ আহমদ (রঃ) কে একটি অমূল্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ খেরকা পরিয়ে দিয়ে বললেন, “শায়েখ আহমদ, মোজাদ্দেদ এর প্রতীক স্বরূপ এই বিশেষ “খিলআত” তোমাকে পরিয়ে দেয়া হলো। এখন থেকে তুমি মোজাদ্দেদ আলফেসানি অর্থাৎ দ্বিতীয় সহ¯্রাব্দের সংস্কারক। আমার উম্মতের দ্বীন ও দুনিয়ার যাবতীয় দায়িত্ব আজ হতে তোমার উপর অর্পিত হলো”। সাধারণত নবী-রাসুল (আঃ) গণ চল্লিশ বছর বয়সে নবুয়ত প্রাপ্ত হন। শায়েখ আহমদও (রঃ) চল্লিশ বছর বয়সে “মোজাদ্দেদ আলফেসানি” এর দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

হযরত গাউসে আজম মহিউদ্দিন আব্দুল কাদের জিলানী (রঃ) পাঁচশ বছর আগে মোজাদ্দেদ আলফেসানি (রঃ)- এর জন্য যে খেরকা মুবারক খাস কামালতে পূর্ণ করে নিজ খলিফা ও সাহেবজাদা হযরত তাজুদ্দিন আব্দুল রাজ্জাক (রঃ) কে প্রদান করে অছিয়ত করে গিয়েছিলেন, তা আমানতস্বরূপ ক্রমাগত ভাবে তাঁর খলিফাদের মাধ্যমে সর্বশেষ হযরত শাহ্ সেকেন্দার কায়থলী (রঃ)-এর নিকট এসে পৌঁছে। তিনি ছিলেন বংশের শেষ খলিফা এবং মোজাদ্দেদ আলফেসানি (রঃ)-এর সমসাময়িক। তিনি একদিন স্বপ্নে দেখেন, তাঁর দাদা কাদেরিয়া তরিকার বিখ্যাত বুজুর্গ হযরত শাহ্ কামাল কায়থলী (রঃ) তাঁকে বলেছেন, “গাউসে আজম (রঃ) এর অছিয়ত অনুযায়ী হযরত মোজাদ্দেদ আলফেসানি (রঃ) কে খেরকা মুবারক পৌঁছে দাও”। কিন্তু তিনি খেরকা শরীফ পৌঁছে দেবার ব্যাপারে উৎসাহ বোধ করলেন না। কিছুদিন পর পূনরায় হযরত শাহ্ কামাল কায়থলী (রঃ) স্বপ্নে তাঁকে খেরকা শরীফ পৌঁছে দেবার জন্য তাগিদ দিলেন। কিন্তু এবারও সেকেন্দার কায়থলী (রঃ) উৎসাহ বোধ করলেন না। তিনি ভাবতে থাকলেন, ঘরের নেয়ামত ঘরেই শোভা পাক।

এর কিছুদিন পর হযরত শাহ্ কামাল কায়থলী (রঃ) পুনরায় খেরকা মুবারক প্রদানের জন্য স্বপ্নে হযরত শাহ্ সেকেন্দার (রঃ) কে তাগিদ দিলেন। তবুও তিনি তা দিলেন না। বিলম্ব দেখে হযরত শাহ্ কামাল (রঃ) পুনর্বার স্বপ্নে হাজির হয়ে রাগত স্বরে বললেন, “যদি তুমি পরকালের নিরাপত্তা কামনা কর এবং তরিকার নেসবত অটুট রাখতে চাও তবে খেরকা শরীফ আজই হযরত শায়েখ আহমদ (রঃ)-এর নিকট অর্পণ কর, না হলে নেসবত ও কামালত সবই সলব করে নেয়া হবে”। এবার স্বপ্ন দেখে শাহ্ সেকেন্দার (রঃ) বিষয়টির গুরুত্ব পূর্ণাঙ্গরূপে অনুধাবন করে ভীতসন্ত্রস্থ হয়ে পড়েন এবং অতি প্রত্যুষে আর কাল বিলম্ব না করে খেরকা মুবারক নিয়ে হযরত মোজাদ্দেদ আলফেসানি (রঃ)-এর বাসগৃহ অভিমুখে রওনা হন।

হযরত মোজাদ্দেদ আলফেসানি (রঃ) ফজরের নামাজের পর মোরাকাবায় ছিলেন। মোরাকাবা শেষ হলে শাহ্ সেকেন্দার (রঃ) তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করে সমুদয় ঘটনা বর্ণনা করেন এবং খেরকা শরীফখানি তাঁর নিকট হস্তান্তর করে দেন।

এরপর হযরত মোজাদ্দেদ আলফেসানি (রঃ) নির্জন কক্ষে চলে আসেন এবং পরম শ্রদ্ধা ও ভক্তিভরে খেরকা শরীফ পরিধান করেন। পরিধানের পর তিনি লক্ষ্য করেন, তাঁকে কেন্দ্র করে বিস্ময়কর ঘটনার প্রকাশ ঘটতে লাগলো। খেরকা শরীফ পরিধানের সঙ্গে সঙ্গে কাদেরিয়া তরিকার নেসবত প্রবল হলো। কাদেরিয়া নূর তাঁকে আচ্ছন্ন করে ফেললো। নক্শবন্দিয়া নেসবত অল্প সময়ের জন্য বিলুপ্ত হয়ে গেলো। কিছুক্ষণ এই অবস্থা চললো। পুনরায় নক্শবন্দিয়া নেসবত প্রবল হলো এবং কাদেরিয়া নেসবতকে ঢেকে ফেললো। পর্যায়ক্রমে কয়েকবার এরূপ ঘটলো।

ইতিমধ্যে হযরত আবদুল কাদের জিলানি (রঃ) তশরীফ আনলেন। তাঁর সাথে আরো তশরীফ আনলেন সৈয়্যেদেনা আমিরুল মোমেনিন হযরত আলী (আঃ) এবং কাদেরিয়া তরিকার অন্যান্য বিশিষ্ট বুজুর্গ (রঃ) গণ। এর কিছুক্ষণ পর আসলেন গরীবে নেওয়াজ হযরত খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি (রঃ) এবং উনার সিলসিলার অন্যান্য বুজুর্গ (রঃ) বৃন্দ। অতঃপর হযরত বাহাউদ্দিন নক্শবন্দ (রঃ), সৈয়্যেদেনা আমিরুল মোমেনিন হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) সহ উনার সিলসিলার সকল বুজুর্গ (রঃ) গণ তশরীফ আনলেন। ক্রমে ক্রমে কিবরিয়া, আলিয়া, সোহরাওয়ার্দিয়া তরিকার বুজুর্গ (রঃ) গণও এসে উপস্থিত হলেন।

এবার আলোচনা শুরু হলো। প্রথম কিছুক্ষণ ইশারা বিনিময় হলো। এরপর হযরত আবদুল কাদের জিলানি (রঃ) বললেন, “হযরত মোজাদ্দেদ শৈশবকালে আমার তরিকার বুজুর্গ শাহ কামাল কায়থলীর জিহŸা চুষে কাদেরিয়া তরিকার সমুদয় কামালত হাসিল করেছিলেন। সেই কারণে আমার তরিকার খেদমত করার জন্য তাঁর উপর আমার দাবী প্রথম”।

হযরত বাহাউদ্দিন নক্শবন্দ (রঃ) বললেন, “আমার সিলসিলার খলিফা হযরত বাকীবিল্লাহর মাধ্যমে তিনি রাসুলপাক (সাঃ) এর বিশেষ আমানত পেয়েছেন। অতএব তিনি আমার সিলসিলার খেদমত করবেন”।

খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি (রঃ) বলে উঠলেন, “তাঁর পূর্ব পুরুষগণ ছিলেন আমারই সিলসিলাভূক্ত। তিনি আমাদেরই কোলে প্রতিপালিত হয়েছেন এবং সর্বপ্রথম আমার তরিকার খেলাফত লাভ করেন। তাই সর্বাপেক্ষা আমার দাবী অগ্রগণ্য”।

কিবরিয়া, আলিয়া ও সোহরাওয়ার্দিয়া বুজুর্গ (রঃ) গণও তাদের নিজ নিজ দাবীর সপক্ষে দলিল পেশ করলেন। বহুক্ষণ ধরে আলোচনা চলতে থাকলো। কিন্তু কেউই দাবী ছাড়তে চাননা। এ মহাগুরুত্বপূর্ণ মাহফিলে অংশগ্রহণ করার জন্য এত অধিক সংখ্যায় অলি-আল্লাহ (রঃ) গণ উপস্থিত হন যে, সেরহিন্দ শরীফের শহর ও শহরতলীর কোথাও কোন জায়গা আর খালি থাকলো না।

অবশেষে এ জটিল বিষয়টির সূক্ষাতিসূক্ষ নিষ্পত্তি করে দেবার জন্য স্বয়ং রাসুলেপাক (সাঃ) তশরীফ আনলেন। অতঃপর বললেন, “আপনারা আপনাদের নেসবতের কামালতসমূহ সম্পূর্ণরূপে হযরত মোজাদ্দেদ আলফেসানিকে সোপর্দ করুন। ইনি আপনাদের সকলেরই খলিফা। আপনারা সকলেই তাঁর নিকট থেকে পারিশ্রমিক লাভ করবেন। কিন্তু যেহেতু নবীদের পরে শ্রেষ্ঠ মানব হযরত সিদ্দীকে আকবর হতে নক্শবন্দিয়া তরিকার উৎপত্তি এবং এতে আজিমাতের সাথে সুন্নতের অনুসরণ ও বেদাত বর্জন করা হয় তাই তাজদীদের (সংস্কারের) বিশেষ খেদমত সম্পাদনের ক্ষেত্রে এ তরিকাটি সর্বাপেক্ষা যোগ্যতাপূর্ণ”।

রাসুলেপাক (সাঃ)-এর পাক জবানে সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেলো। রাসুলেপাক (সাঃ)-এর নির্দেশ অনুযায়ী পূর্ববর্তী প্রত্যেক তরিকতের ঈমাম (রঃ) গণই নিজ নিজ তরিকার পরিপূর্ণ কামালত সর্বশেষ তরিকতের ঈমাম হযরত মোজাদ্দেদ আলফেসানি (রঃ) কে প্রদান করলেন। এর সাথে যুক্ত হলো মোজাদ্দেদ আলফেসানি (রঃ)- এর নিজস্ব খাস কামালত ও নেসবত এবং রাসুলেপাক (সাঃ) কর্তৃক প্রদত্ত খাস কামালতসমূহ। এ ছাড়াও মিশ্রিত হলো কাইয়ুমুনিয়াত, ঈমামত, খাজিনাতুর রহমত প্রভৃতি বিশেষ কামালত। ইসলামের ইতিহাসে জন্ম নিলো সর্বপ্রকার কামালতে পরিপূর্ণ এক মহাপবিত্র, শ্রেষ্ঠ এবং সর্বশেষ তরিকা, যে সিলসিলার নাম “তরিকায়ে মোজাদ্দেদিয়া”।

তরিকতের শেষ ঈমাম হযরত মোজাদ্দেদ আলফেসানি (রঃ) তাঁর পাক জবানে বলেছেন, “যদি কোন অভাগা আমার এ সিলসিলার সন্ধান তার সারা জীবনে জানতে না পারে, পুনুরুত্থানের দিবসে সে পুতপবিত্র হয়ে জাগ্রত হবে”।

সুতরাং আমরা যারা এ মোজাদ্দেদিয়া তরিকার নাম জেনেছি তাদের দায়িত্ব দুইটিঃ

১- মোজাদ্দেদিয়া তরিকার সঠিক সিলসিলা কোথায় রয়েছে তা পক্ষপাতহীন ভাবে ইতিহাস ও নির্মম বাস্তবতার নিরিখে সূক্ষাতিসূক্ষ বিচার বিশ্লেষণপূর্বক জামানার সঠিক ও জিন্দা মোজাদ্দেদ কোথায় রয়েছেন তা নির্ধারণ করা এবং তাঁর কাছে বায়আত গ্রহণপূর্বক নেসবতের কামালত হাসিল করে মানবজন্মকে ধন্য করা। কারণ একটা জামানায় মূল মোজাদ্দেদ একজনই থাকেন এবং তিনি আর একজনকে জীবনভর ধীরে ধীরে তৈরি করতে থাকেন তাঁর খলিফা হিসেবে।

২- আমরা যারা মোজাদ্দেদিয়া সিলসিলার নেসবতের সন্ধান জেনে ফেলেছি এবং আরো নির্ধারণ করে ফেলেছি কোন দরবার শরীফে জামানার মহান মোজাদ্দেদ অবস্থান করছেন, তাদের সুমহান দায়িত্ব হলো যারা সাধারণ মানুষ তাদের কাছে এ মহান নেসবতের সুসংবাদ পৌঁছে দেয়া এবং দরবারমুখী করার জন্য অবিরত চেষ্টা করা যেন আমজনতা জামানার পরশমণিতুল্য মোজাদ্দেদের দর্শনে এবং খাস তাওয়াজ্জোহে নিজেকে খাঁটি মুমিন মুসলমানে পরিণত করতে পারে। মোজাদ্দেদিয়া নেসবতের সঠিক দরবার থেকেই খাঁটি ইসলাম প্রচার ও প্রসার হয়, যেভাবে হয়েছে পূর্ববর্তী নবী-রাসুল (আঃ) এবং অলি-আল্লাহ (রঃ) গণের দরবার শরীফ থেকে। রাসুলেপাক (সাঃ) বলেছেন, “আমার উম্মতের মধ্যে সেই শ্রেষ্ঠ যে আমার খাঁটি ইসলামকে যতুটুকু জানলো তা অন্যকে জানালো।

রাসুলেপাক হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) আল্লাহর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি, সর্বশ্রেষ্ঠ পয়গম্বর এবং সর্বশেষ নবী ও রাসুল। তিনি নিখিল বিশ্ব সৃষ্টির ওসিলা এবং রহমাতুল্লিল আলামীন (সমগ্র জগৎ-এর জন্য রহমত স্বরূপ)। তিনি মহান আল্লাহর পবিত্র নূর মুবারক হতে সৃষ্ট এবং বিশ্বের যাবতীয় সৃষ্টিই তাঁর পবিত্র নূর মুবারক হতে সৃষ্ট। রাসুলেপাক (সাঃ)- এর অনেক নামের মধ্যে মুহাম্মদ এবং আহমদ নামই বেশী পরিচিত। মুহাম্মদ নামের অর্থ চরম প্রশংসিত এবং আহমদ শব্দের অর্থ চরম প্রশংসাকারী। তিনি একদিকে আল্লাহর পরিপূর্ণ মহব্বতে বিশুদ্ধ ইবাদত এবং ইসলাম প্রচার ও প্রতিষ্ঠার দ্বারা আল্লাহর সর্বোচ্চ সন্তুষ্টি এবং সান্নিধ্য লাভ করে সুখ্যাতির চরম সীমায় পৌঁছেছিলেন, অন্যদিকে নিখিল বিশ্বের প্রতিটি সৃষ্টিতে পূর্ণাঙ্গ আদর্শের প্রতিফলন ঘটিয়ে প্রশংসার চুড়ান্ত লাভ করেছিলেন। এ জন্য তিনি চরম প্রশংসিত। আবার তিনি আল্লাহর পরিচয়ের চরম সীমায় উপনীত হয়ে মহান আল্লাহর যে প্রশংসা ও পরিচয় প্রদান করেছিলেন তা মানুষের পক্ষে সর্বোচ্চ, এ জন্য তিনি চরম প্রশংসাকারী। পৃথিবীর সৃষ্টি থেকে কেউ এ দুই নামের অধিকারী হয়নি এবং কেয়ামত পর্যন্ত কেউ হবেও না।

সমগ্র বিশ্বে যখন তাওরাত, যবুর, ইঞ্জিল, বেদ, বাইবেল প্রভৃতি ধর্মগ্রন্থ বিকৃত ও রূপান্তরিত হয়ে আল্লাহর একেশ্বরবাদ বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিলো; যখন এক আল্লাহর ইবাদত বন্ধ হয়ে তাঁরই বিভিন্ন সৃষ্টি যেমন- প্রতিমা, প্রকৃতি, প্রতীক, পুরোহিত, ভুত-প্রেত, বিভিন্ন জড় পদার্থ, চাঁদ-সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্রের পূজা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছিলো; যখন রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও নৈতিক শৃংখলার অভাব হওয়ায় অবিচার, অত্যাচার, ব্যভিচার, কলহ-বিবাদ, কন্যা শিশু জ্যান্ত পুতে ফেলা ইত্যাদি অনাচার সর্বগ্রাসী রূপ গ্রহণ করেছিলো- সেই অসত্যের গভীর অন্ধকার দূর করতে মরুময় আরবে হিজরী সালের (৫৭০ খ্রীষ্টাব্দ) রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখে বিখ্যাত কুরাইশ বংশের বনি হাশিম গোত্রে অভূতপূর্ব নূরের সূর্যরূপে তশরীফ আনেন শ্রেষ্ঠ পয়গম্বর হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)। তাঁর জ্যোতির্ময় নূরের প্রভাবে দলে দলে মানুষ অসত্য বিচরণ বন্ধ করে শান্তিময় ইসলামের পতাকাতলে জড়ো হতে শুরু করে। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর পূর্ববর্তী সকল পয়গম্বরগণ এ পৃথিবীতে তশরীফ এনেছিলেন তাঁদের নিজ নিজ সম্প্রদায়ের হেদায়েতের (পথ নির্দেশ) জন্য। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ সূরা ফাতির-এর ২৪ নং আয়াত এবং সূরা রাদ-এর ৭ নং আয়াতে প্রত্যেক সম্প্রদায় বা জাতির মধ্যে একজন করে পথপ্রদর্শক বা হাদী বা সতর্ককারী প্রেরণের কথা উল্লেখ করেছেন। আর হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) কে মহান আল্লাহ সমগ্র বিশ্বের হেদায়েতের জন্য প্রেরণ করেছেন। পবিত্র কুরআনে সর্বশ্রোতা আল্লাহ বলেছেন,

وَما أَرسَلنٰكَ إِلّا كافَّةً لِلنّاسِ بَشيرًا وَنَذيرًا وَلٰكِنَّ أَكثَرَ النّاسِ لا يَعلَمونَُ

অর্থ: হে মাহবুব! আমি আপনাকে প্রেরণ করেছি এমন রিসালাত সহকারেই, যা সমগ্র মানব জাতিকে পরিব্যাপ্ত করে দেয় সুসংবাদদাতা এবং সতর্ককারী রূপে, কিন্তু অনেক লোক জানে না। (সূরা সাবা, আয়াত-২৮)

সম্মানদানকারী আল্লাহ বিশ্বমানবতার মুক্তিদূত হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর বিভিন্ন চারিত্রিক গুণাবলী ও প্রশংসনীয় গুণের ব্যাপারে ইরশাদ করেন,

وَإِنَّكَ لَعَلىٰ خُلُقٍ عَظيمٍُ

অর্থ: নিশ্চয়ই আপনি সুমহান চরিত্রের সর্বোচ্চ স্থানে অধিষ্ঠিত। (সূরা আল ক্বালাম, আয়াত-৪)

সৎপথ প্রদর্শক আল্লাহ দয়াল নবীর ইসলামের সত্য তরিকা বা পথে অবিচল থাকার ব্যাপারে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে বলেছেন,

ما ضَلَّ صاحِبُكُم وَما غَوىُُٰ

অর্থ: তোমাদের ‘সাহিব’ এ রাসুল পথভ্রষ্ট হননি এবং ভ্রান্তপথও অবলম্বন করেননি। (সূরা আন নাজম, আয়াত-২)। সাহিব অর্থ সাথী অর্থাৎ রাসুলেপাক (সাঃ) ইহকাল ও পরকালের সর্বসময়ের সঙ্গী।

হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ পয়গম্বর বলেই তাঁর পূর্ববর্তী পয়গম্বর (আঃ) গণের ধর্মগ্রন্থে তাঁর সম্পর্কে উচ্চ প্রশংসা ও আগমনীবার্তা ঘোষিত হয়েছিলো। হিন্দুদের অথর্ব্ববেদীয় উপনিষদে, ভবিষ্যপুরাণে ভোজরাজ উপাচে, আল্লা উপনিষদে, শামবেদ ও অথর্ব্ববেদে রাসুল (সাঃ)-এর প্রশংসা ও আগমনীবার্তা লিখিত আছে। বৌদ্ধদের প্রামান্য গ্রন্থ দিঘানিকার, পারশিকদের ধর্ম গ্রন্থ জেন্দ আবেস্তায় ও দশাতীরে, ইহুদীদের ধর্ম গ্রন্থ তাওরাতে এবং খ্রিষ্টানদের ধর্ম গ্রন্থ বাইবেলে রাসুল (সাঃ)-এর প্রশংসা এবং আগমনীবার্তা লিপিবদ্ধ আছে।

মূর্তিপূজার মুলোৎপাটন করা, একত্ববাদী, দ্বিত্ববাদী, ত্রিত্ববাদী এবং বহুত্ববাদীদের ভ্রম ও কুসংস্কার দূর করে তৌহিদের বাণী প্রচার করে খাঁটি ইসলাম ধর্মের প্রতিষ্ঠা করাই ছিলো হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর জীবনের উদ্দেশ্য। চল্লিশ বছর বয়সে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) যখন নবুয়ত লাভ করেন তখন মহাপরাক্রমশালী ও পরম দয়ালু আল্লাহ তাঁকে কালেমা তয়্যেবা “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ” প্রদান করেন এবং এ দ্বারা বিপদগামী ও পথভ্রষ্ঠ মানুষকে বায়আত করিয়ে ইসলাম গ্রহণ করতঃ মুমিন মুসলমান বানানোর নির্দেশ দেন। দয়াল নবী রাসুল (সাঃ) তাঁর সারা জীবন এ কালেমা দিয়েই বায়আত করিয়ে সাহাবী (রাঃ) গণকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করান এবং খাঁটি ঈমানদার তৈরি করেন। মূলত রাসুল (সাঃ) যা কিছু নিয়ে এসেছেন, সব কিছুর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করাকে ঈমান বলে। রাসুল (সাঃ)-এর অভিমুখী হওয়া ঈমানের পূর্বশর্ত। রাসুল (সাঃ)-এর আনীত বিধানের নামই ইসলাম। আর ইসলামের মূল ভিত্তি হলো কালেমা, যার অর্থ- আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নেই এবং মুহাম্মদ (সাঃ) আল্লাহর রাসুল।

যখন কোন ব্যক্তি রাসুল (সাঃ)-এর কাছে তওবা করে কালেমার মাধ্যমে বায়আত গ্রহণ করে মুসলমান হতেন, তখন তিনি রাসুল (সাঃ)-এর আনীত কালেমা মৌখিক স্বীকৃতির সাথে সাথে অন্তর বা ক্বলবে বিশ্বাস স্থাপন করতেন। ফলে রাসুল (সাঃ)-এর নূরের তাওয়াজ্জোহতে বায়আত গ্রহণকারী ব্যক্তির পাপাচারের কারণে অন্ধকার হয়ে যাওয়া ক্বলবের তমসা নিমিষেই দূরীভূত হয়ে পরিশুদ্ধ হয়ে নবজাতক শিশুর মতো পাক-পবিত্র হয়ে যেতো। এজন্য ইসলামে মানুষের অন্তঃকরণ বা ক্বলব স্বচ্ছ, নির্মল ও পরিশুদ্ধ করার প্রতি সর্বপ্রথমে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। কারণ মানুষের সকল কর্মের উৎস তার ক্বলব (আন্তঃকরণ)। এ ক্বলব পরিশুদ্ধির জন্য আনুষ্ঠানিকতা শুরুর নামই বায়আত যা দ্বারা সত্য সন্ধানী মানুষ ইসলামে নিজেকে অন্তর্ভূক্ত করেন। রাসুল (সাঃ) বলেছেন, “মানবদেহে রয়েছে একটি মাংসপিন্ড, সেটি সুস্থ থাকলে পুরো দেহ সুস্থ থাকে আর সেটি বিনষ্ট হলে পূর্ণ দেহ বিনষ্ট হয়; সেটি হলো ক্বলব”। এ ক্বলব মানবদেহের বাম স্তনের দুই আঙুল নিচে অবস্থান করে। কেউ যখন বায়আত গ্রহণ করতেন রাসুল (সাঃ)-এর কাছে, তখন রাসুল (সাঃ) তার ক্বলবে আসীন হতেন। হুজুর হলেন রাসুল (সাঃ), যার অর্থ মহাসম্মানিত। এই হুজুরী ক্বলবেই রাসুল (সাঃ) নামায পড়তে আদেশ করেছেন যা পবিত্র হাদিস শরীফে এসেছে। এ কারণেই রাসুল (সাঃ) বলেছেন, “কুলুবিন মুমিনিন আরশাল্লাহ, অর্থ- আল্লাহর আরশ মুমিনের ক্বলবে”। এ বায়আতের আধ্যাত্মিক আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে ইসলামে প্রবেশের প্রক্রিয়া নক্শবন্দিয়া মোজাদ্দেদিয়া তরিকার আউলিয়ার মাধ্যমে এখন পর্যন্ত চলমান আছে এবং ঈমাম মেহেদী (আঃ) আসা পর্যন্ত চলতে থাকবে। পবিত্র কুরআনে ক্বলবের পবিত্রতার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করতে মহাপবিত্র আল্লাহ বলেছেন,

قَد أَفلَحَ مَن زَكّىٰها ُ وَقَد خابَ مَن دَسّىٰها ُ

অর্থ: ৯. সফলকাম হয়েছে সেই ব্যক্তি যে তার অন্তরকে (ক্বলব) পবিত্র করেছে, ১০. এবং ব্যর্থ হয়েছে সে, যে সেটাকে পাপের মধ্যে আচ্ছন্ন করেছে। (সূরা আশ-শামস্, আয়াত-৯,১০)

নবী করিম (সাঃ) প্রেরিত হয়েছেন সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হিসেবে এবং শেষ আসমানি গ্রন্থ আল-কুরআন দীর্ঘ তেইশ বছর ধরে তাঁর উপর নাযিল হয়েছে।

রূহের জগৎ-এ মহান আল্লাহ হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর আত্মাকে কেন্দ্র করেই সকল নবী-রাসুল (আঃ) গণের অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলেন। পবিত্র কুরআনে সর্বত্র বিরাজমান আল্লাহ এ আধ্যাত্মিক ইতিহাস বর্ণনা করেছেন,

وَإِذ أَخَذَ اللَّهُ ميثٰقَ النَّبِيّۦنَ لَما ءاتَيتُكُم مِن كِتٰبٍ وَحِكمَةٍ ثُمَّ جاءَكُم رَسولٌ مُصَدِّقٌ لِما مَعَكُم لَتُؤمِنُنَّ بِهِ وَلَتَنصُرُنَّهُ قالَ ءَأَقرَرتُم وَأَخَذتُم عَلىٰ ذٰلِكُم إِصرى قالوا أَقرَرنا قالَ فَاشهَدوا وَأَنا۠ مَعَكُم مِنَ الشّٰهِدينَُ

অর্থ: স্মরণ করুন! যখন আল্লাহ নবীগণের নিকট থেকে তাঁদের অঙ্গীকার নিয়েছিলেন১, আমি তোমাদেরকে যে কিতাব ও হিকমত প্রদান করবো, অতঃপর তশরীফ আনবেন তোমাদের নিকট২ ওই রাসুল (সাঃ), যিনি তোমাদের কিতাব গুলোর সত্যায়ন করবেন৩, তখন তোমরা (নবী-রাসুল আলাইহিসসাল্লামগণ) নিশ্চয় নিশ্চয় তাঁর (সাঃ) উপর ঈমান আনবে৪ এবং নিশ্চয় নিশ্চয় তাঁকে সাহায্য করবে। আল্লাহ ইরশাদ করলেন, “তোমরা কি স্বীকার করলে এবং এ সম্পর্কে আমার গুরুদায়িত্ব গ্রহণ করলে”? সবাই আরয করলো, “আমরা স্বীকার করলাম”। আল্লাহ ইরশাদ করলেন, “তবে (তোমরা) একে অপরের সাক্ষী হয়ে যাও এবং আমি নিজেই তোমাদের সাথে সাক্ষীদের মধ্যে রইলাম”। (সূরা আল-ইমরান, আয়াত-৮১)

উপরোক্ত আয়াত থেকে স্পষ্ট হয় যে-

১. হযরত আদম (আঃ) থেকে হযরত ঈসা (আঃ) পর্যন্ত সকলের কাছ থেকে আল্লাহ অঙ্গীকার নিয়েছেন এবং নবী (আঃ) গণের অঙ্গীকারের মাধ্যমে স্বীয় উম্মতদের অঙ্গীকারও হয়ে গেছে। কেননা, উম্মত পয়গম্বরেরই অধীনস্থ হয়। ঈমামের চুক্তি গোটা সম্প্রদায়েরই চুক্তির সামিল।

২. রাসুল (সাঃ) পূর্ব ও পরবর্তী সবারই নিকট তশরীফ এনেছেন। পূর্ব ও পরবর্তী সবাই মুহাম্মদ (সাঃ)-এর উম্মত। তিনি (সাঃ) সকল নবী-রাসুল (আঃ) গণেরও নবী। এ কারণে সমস্ত নবী (আঃ) গণ মেরাজের রাতে রাসুল (সাঃ)-এর পেছনে নামায পড়েছেন। নামাযও পড়েছেন মুহাম্মদী নামায, ঈসায়ী কিংবা মুসায়ী নামায পড়েননি।

৩. রাসুল (সাঃ) এবং সর্বশেষ আসমানি গ্রন্থ আল-কুরআনের পর কোন নবী ও কোন কিতাব আসবে না। সমস্ত আসমানি গ্রন্থ ও নবী (আঃ) গণের সত্যায়ন তাই সর্বশেষ নবী হিসেবে রাসুলেপাকই (সাঃ) করেছেন। সত্যায়ন করা হয় পূর্ববতীদের আর সুসংবাদ দেয়া হয় পরবর্তীদের।

৪. সমস্ত নবী-রাসুল (আঃ) গণ ওই দিন রাসুলেপাক (সাঃ)-এর উপর ঈমান এনেছেন।

নবী করিম (সাঃ)-এর আগমনের মাধ্যমে নবী-রাসুল (আঃ) গণের আগমনের ধারা সমাপ্ত হয়ে যায়। সুতারং তিনিই (সাঃ) শেষ নবী এবং রাসুল। এ বিষয়ে সর্বদর্শী আল্লাহ ইরশাদ করেন,

ما كانَ مُحَمَّدٌ أَبا أَحَدٍ مِن رِجالِكُم وَلٰكِن رَسولَ اللَّهِ وَخاتَمَ النَّبِيّۦنَ وَكانَ اللَّهُ بِكُلِّ شَيءٍ عَليمًاُُ

অর্থ: মুহাম্মদ তোমাদের পুরুষদের মধ্যে করো পিতা নন, বরং আল্লাহর রাসুল এবং সমস্ত নবীর মধ্যে সর্বশেষ। আর আল্লাহ সবকিছু জানেন। (সূরা আল-আহযাব, আয়াত-৪০)

একই বিষয়ে রাসুলেপাক (সাঃ) বলেছেন, “আমিই শেষ নবী। আমার পরে কোন নবী নেই”। (মুসলিম)। রাসুলেপাক (সাঃ) আরো বলেছেন, “অচিরেই আমার উম্মতের মধ্যে মিথ্যাবাদীর আবির্ভাব হবে। তারা প্রত্যেকেই নবী হবার দাবী করবে। অথচ আমিই সর্বশেষ নবী। আমার পর আর কোন নবী আসবে না”। (আবু দাউদ)

দয়াল নবী হুজুরেপাক (সাঃ)-এর আগমনের পর পূর্ববর্তী সকল আসমানি গ্রন্থ এবং সকল নবী (আঃ) গণের শিক্ষা স্থগিত হয়ে যায়। কিন্তু তাঁদের সকলের উপর বিশ্বাস স্থাপন করা অপরিহার্য। এ ব্যাপারে মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ বলেছেন,

ءامَنَ الرَّسولُ بِما أُنزِلَ إِلَيهِ مِن رَبِّهِ وَالمُؤمِنونَ كُلٌّ ءامَنَ بِاللَّهِ وَمَلٰئِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ لا نُفَرِّقُ بَينَ أَحَدٍ مِن رُسُلِهِ ُ

অর্থ: রাসুল ঈমান এনেছেন সেটার উপর, যা তাঁর রবের নিকট থেকে তাঁর উপর অবতীর্ণ হয়েছে এবং মুমিনগণও। সবাই মেনে নিয়েছে আল্লাহ, তাঁর ফেরেশতাগণ, তাঁর কিতাবসমূহ এবং তাঁর রাসুলগণকে, এ কথা বলে যে, আমরা তাঁর কোন রাসুলের উপর ঈমান আনার মধ্যে তারতম্য করি না। (সূরা বাকারা, আয়াত-২৮৫)

মহান আল্লাহ আরো বলেছেন,

قُل يٰأَيُّهَا النّاسُ إِنّى رَسولُ اللَّهِ ُ

অর্থ: (হে নবী) আপনি বলুন, “হে মানবকুল! আমি তোমাদের সকলের জন্যই আল্লাহর রাসুল হিসেবে প্রেরিত”। (সূরা আল-আরাফ, আয়াত-১৫৮)

দয়াময় আল্লাহ আরো বলেছেন,

وَما أَرسَلنٰكَ إِلّا رَحمَةً لِلعٰلَمينَ ُ

অর্থ: (হে নবী) আমি তো আপনাকে সমগ্র জগতের জন্য রহমতরূপেই (রহমাতাল্লিল আলামীন) প্রেরণ করেছি। (সূরা আম্বিয়া, আয়াত-১০৭)

আর রাসুল (সাঃ)-এর উপর নাযিলকৃত আসমানি গ্রন্থ আল-কুরআনের মহাগুরুত্ব সম্পর্কে পরম করুণাময় আল্লাহ ইরশাদ করেন,

إِنَّ فى هٰذا لَبَلٰغًا لِقَومٍ عٰبِدينَُ

অর্থ: নিশ্চয় এ কুরআন যথেষ্ট ইবাদতকারীদের জন্য (সূরা আম্বিয়া, আয়াত-১০৬)। সুতরাং রাসুল আহমদ (সাঃ) হলেন সর্বকালের নবী। কিয়ামত পর্যন্ত যত মানুষ আগমন করবে সকলের নবী তিনিই। তাঁর শিক্ষা, আদর্শ ও আনীত কিতাব আল-কুরআন সকলকেই অনুসরণ করতে হবে।

সর্বজ্ঞ ও সৎপথ প্রদর্শক আল্লাহ পবিত্র কুরআনে রাসুল (সাঃ)-এর মর্যাদা, তাঁর আনীত ধর্ম ইসলাম এবং এ ইসলামের বিজয় গাঁথা উল্লেখ করে বলেছেন,

هُوَ الَّذى أَرسَلَ رَسولَهُ بِالهُدىٰ وَدينِ الحَقِّ لِيُظهِرَهُ عَلَى الدّينِ كُلِّهِ وَلَو كَرِهَ المُشرِكونَُ

অর্থ: তিনিই আল্লাহ, যিনি আপন রাসুলকে হেদায়েত (পথনির্দেশ) ও সত্য দ্বীন সহকারে প্রেরণ করেছেন এজন্য যে, সেটাকে অন্য সমস্ত দ্বীনের উপর বিজয়ী করবেন, যদিও অপ্রীতিকর মনে করে মুশরিকরা (অংশীবাদীরা)। (সূরা তওবা, আয়াত-৩৩)

এ ব্যাপারে সর্বশক্তিমান আল্লাহ আরো ইরশাদ করেন,

هُوَ الَّذى أَرسَلَ رَسولَهُ بِالهُدىٰ وَدينِ الحَقِّ لِيُظهِرَهُ عَلَى الدّينِ كُلِّهِ وَكَفىٰ بِاللَّهِ شَهيدًا ُ

অর্থ: তিনিই, যিনি আপন রাসুলকে সঠিক হেদায়েত ও সত্য দ্বীন সহকারে প্রেরণ করেছেন, যাতে সেটাকে সমস্ত দ্বীনের উপর বিজয়ী করেন এবং সাক্ষী হিসেবে আল্লাহই যথেষ্ট। (সূরা আল-ফাতহ, আয়াত-২৮)

বিজয়দানকারী আল্লাহ দয়াময় নবী (সাঃ)-এর শান, মান ও মর্যাদা অঙ্কিত করে যেসব আয়াত নাযিল করেছেন, তার কিছু নিচে উল্লেখ করা হলোঃ

সূরা আল-আহযাব

يٰأَيُّهَا النَّبِىُّ إِنّا أَرسَلنٰكَ شٰهِدًا وَمُبَشِّرًا وَنَذيرًا ُ وَداعِيًا إِلَى اللَّهِ بِإِذنِهِ وَسِراجًا مُنيرًا ُ

অর্থ: ৪৫. হে অদৃশ্যের সংবাদদাতা (নবী)! নিশ্চয় আমি আপনাকে প্রেরণ করেছি হাজির-নাজির করে, সুসংবাদদাতা এবং সতর্ককারীরূপে। ৪৬. এবং আল্লাহর প্রতি তাঁর নির্দেশে আহŸানকারী আর আলোকোজ্জ্বলকারী সূর্যরূপে। (সূরা আল-আহযাব, আয়াত-৪৫,৪৬)

সূরা আল-ফাতহ

إِنّا أَرسَلنٰكَ شٰهِدًا وَمُبَشِّرًا وَنَذيرًا ُ لِتُؤمِنوا بِاللَّهِ وَرَسولِهِ وَتُعَزِّروهُ وَتُوَقِّروهُ وَتُسَبِّحوهُ بُكرَةً وَأَصيلًاُ ُ ُ

অর্থ: ৮. নিশ্চয় আমি আপনাকে প্রেরণ করেছি হাজির-নাজির এবং সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী করে। ৯. যাতে হে লোকেরা! তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের উপর ঈমান আনো এবং রাসুলের মহত্ব বর্ণনা ও (তাঁর প্রতি) সম্মান প্রদর্শন করো আর সকাল-সন্ধ্যা আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণা করো। (সূরা আল-ফাতহ, আয়াত-৮,৯)

সূরা মুয্যাম্মিল

إِنّا أَرسَلنا إِلَيكُم رَسولًا شٰهِدًا عَلَيكُم كَما أَرسَلنا إِلىٰ فِرعَونَ رَسولًا ُ

অর্থ: নিশ্চয় আমি তোমাদের প্রতি একজন রাসুল প্রেরণ করেছি, যিনি তোমাদের উপর হাজির-নাজির; যেভাবে আমি ফেরাউনের প্রতি রাসুল প্রেরণ করেছি। (সূরা মুয্যাম্মিল, আয়াত-১৫)

সূরা নিসা

يٰأَيُّهَا النّاسُ قَد جاءَكُمُ الرَّسولُ بِالحَقِّ مِن رَبِّكُم فَـٔامِنوا خَيرًا لَكُم وَإِن ُ

অর্থ: হে মানবজাতি! তোমাদের নিকট এ রাসুল সত্য সহকারে তোমাদের রবের নিকট থেকে শুভাগমন করেছেন, সুতরাং ঈমান আনো তোমাদের কল্যাণার্থে। (সূরা নিসা, আয়াত-১৭০)

সূরা বাকারা

كَما أَرسَلنا فيكُم رَسولًا مِنكُم يَتلوا عَلَيكُم ءايٰتِنا وَيُزَكّيكُم وَيُعَلِّمُكُمُ الكِتٰبَ وَالحِكمَةَ وَيُعَلِّمُكُم ما لَم تَكونوا تَعلَمونَ ُ

অর্থ: যেমন আমি তোমাদের মধ্যে প্রেরণ করেছি একজন রাসুল তোমাদের মধ্যে থেকে, যিনি তোমাদের উপর আমার আয়াত গুলো তেলওয়াত করেন, তোমাদেরকে পবিত্র করেন এবং কিতাব ও পরিপক্ক জ্ঞান শিক্ষা দেন। আর তোমাদের ওই শিক্ষা দান করেন, যার জ্ঞান তোমাদের ছিলোনা। (সূরা বাকারা, আয়াত-১৫১)

وَكَذٰلِكَ جَعَلنٰكُم أُمَّةً وَسَطًا لِتَكونوا شُهَداءَ عَلَى النّاسِ وَيَكونَ الرَّسولُ عَلَيكُم شَهيدًاُُ

অর্থ: এবং কথা হলো এই যে, আমি তোমাদেরকে সব উম্মতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ করেছি, যাতে তোমরা মানবজাতির উপর সাক্ষী হও। আর এ রাসুল তোমাদের রক্ষক ও সাক্ষী। (সূরা বাকারা, আয়াত-১৪৩)

সূরা নিসা

فَكَيفَ إِذا جِئنا مِن كُلِّ أُمَّةٍ بِشَهيدٍ وَجِئنا بِكَ عَلىٰ هٰؤُلاءِ شَهيدًا ٌ

অর্থ: তবে কেমন হবে যখন আমি প্রত্যেক উম্মত থেকে একজন সাক্ষী উপস্থিত করবো? এবং হে মাহবুব! আপনাকে তাদের সবার উপর সাক্ষী এবং পর্যবেক্ষণকারী রূপে উপস্থিত করবো। (সূরা নিসা, আয়াত-৪১)

রাসুল (সাঃ)-এর দ্বীনের প্রতিটি বিধান মধ্যম, এ দ্বীনে যেমনি মুসা (আঃ)-এর দ্বীনের মতো কঠোরতা নেই, তেমনি ঈসা (আঃ)-এর দ্বীনের মতো শিথিলতাও নেই। মহান আল্লাহ কেয়ামত পর্যন্ত মানুষকে সরল পথে আনয়নের লক্ষ্যে প্রেরণ করেছেন রাসুল (সাঃ) কে হাজির-নাজির নূর রূপে। এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন,

فَأَمَّا الَّذينَ ءامَنوا بِاللَّهِ وَاعتَصَموا بِهِ فَسَيُدخِلُهُم فى رَحمَةٍ مِنهُ وَفَضلٍ وَيَهديهِم إِلَيهِ صِرٰطًا مُستَقيمًا ٌ ُ

অর্থ: হে মানবকুল, নিশ্চয় তোমাদের নিকট আল্লাহর পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট প্রমাণ এসেছে এবং আমি তোমাদের প্রতি উজ্জ্বল আলো (নূর) অবতীর্ণ করেছি। (সূরা নিসা, আয়াত-১৭৫)

রাসুলেপাক (সাঃ) আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষের জন্য মহাঅনুগ্রহ এবং তাঁর (সাঃ) উম্মতের প্রতি ভালোবাসার গভীরতা সম্পর্কে মহিমান্বিত আল্লাহ ইরশাদ করেন,

قَد جاءَكُم مِنَ اللَّهِ نورٌ وَكِتٰبٌ مُبينٌ ٌ يَهدى بِهِ اللَّهُ مَنِ اتَّبَعَ رِضوٰنَهُ سُبُلَ السَّلٰمِ وَيُخرِجُهُم مِنَ الظُّلُمٰتِ إِلَى النّورِ بِإِذنِهِ وَيَهديهِم إِلىٰ صِرٰطٍ مُستَقيمٍ ٌ

অর্থ: ১৫. নিশ্চয় তোমাদের নিকট আল্লাহর পক্ষ থেকে একটা “নূর” এসেছে এবং স্পষ্ট কিতাব, ১৬. আল্লাহ তা দ্বারা সরল পথ প্রদর্শন করেন তাকেই যে আল্লাহর সন্তুষ্টি মোতাবেক চলে নিরাপত্তার পথে এবং তাদেরকে অন্ধকাররাশি থেকে আলোর দিকে নিয়ে যান স্বীয় নির্দেশে; এবং তাদেরকে সরল পথ দেখান। (সূরা মায়েদা, আয়াত-১৫,১৬)।

একই ব্যাপারে মহাঅনুগ্রহকারী আল্লাহ বলেন,

لَقَد جاءَكُم رَسولٌ مِن أَنفُسِكُم عَزيزٌ عَلَيهِ ما عَنِتُّم حَريصٌ عَلَيكُم بِالمُؤمِنينَ رَءوفٌ رَحيمٌُ

অর্থ: নিশ্চয় তোমাদের নিকট তশরীফ এনেছেন তোমাদের মধ্য থেকে ওই রাসুল, যার নিকট তোমাদের কষ্টে পড়া কষ্টদায়ক, তোমাদের কল্যাণ অতিমাত্রায় কামনাকারী, মুসলমানদের উপর পূর্ণ দয়ার্দ্র, দয়ালু। (সূরা তওবা, আয়াত-১২৮)

নবী করিম (সাঃ)-এর মর্যাদাশীল গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে সকল সম্মান ও গৌরবের অধিকারী আল্লাহ বলেন,

النَّبِىُّ أَولىٰ بِالمُؤمِنينَ مِن أَنفُسِهِم وَأَزوٰجُهُ أُمَّهٰتُهُم وَأُولُوا الأَرحامِ ٌ

অর্থ: এ নবী মুসলমানদের কাছে তাদের প্রাণ অপেক্ষাও বেশী মালিক এবং তাঁর স্ত্রীগণ তাদের মাতা। (সূরা আল-আহযাব, আয়াত-৬)

মালিক মানে বেশী মালিকানা-বিশিষ্ট, বেশী নিকটে, বেশী হক্বদার। এটাও বুঝা যায় যে, রাসুল (সাঃ) প্রত্যেক মুমিনের অন্তরে হাজির ও নাজির অর্থাৎ প্রাণ অপেক্ষাও নিকটে। একথাও বুঝা গেলো যে, হুজুরের (সাঃ) হুকুম প্রত্যেক বাদশাহ্ ও মাতা-পিতার নির্দেশ অপেক্ষা বেশী কার্যকর। হুজুর (সাঃ) আমাদের সর্বাপেক্ষা বেশী মালিক। এ জন্যই পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ বলেছেন,

قُل بِفَضلِ اللَّهِ وَبِرَحمَتِهِ فَبِذٰلِكَ فَليَفرَحوا هُوَ خَيرٌ مِمّا يَجمَعونَ ٌ

অর্থ: আপনি বলুন, আল্লাহরই অনুগ্রহ ও তাঁরই দয়া, সেটার উপর তাদের আনন্দ প্রকাশ করা উচিত। তা তাদের সমস্ত ধনদৌলত অপেক্ষা শ্রেয়। (সূরা ইউনুস, আয়াত-৫৮)। এখানে অনুগ্রহ ও দয়া বলতে রাসুল (সাঃ) ও পবিত্র কুরআনকে বোঝানো হয়েছে।

একই ব্যাপারে মহাঅনুগ্রহকারী আল্লাহ বলেন,

وَما أَرسَلنا مِن رَسولٍ إِلّا لِيُطاعَ بِإِذنِ اللَّهِ وَلَو أَنَّهُم إِذ ظَلَموا أَنفُسَهُم جاءوكَ فَاستَغفَرُوا اللَّهَ وَاستَغفَرَ لَهُمُ الرَّسولُ لَوَجَدُوا اللَّهَ تَوّابًا رَحيمًا ٌ فَلا وَرَبِّكَ لا يُؤمِنونَ حَتّىٰ يُحَكِّموكَ فيما شَجَرَ بَينَهُم ثُمَّ لا يَجِدوا فى أَنفُسِهِم حَرَجًا مِمّا قَضَيتَ وَيُسَلِّموا تَسليمًا ٌ

অর্থ: ৬৪. এবং আমি কোন রাসুল প্রেরণ করিনি কিন্তু এ জন্য যে, আল্লাহর নির্দেশে তাঁর আনুগত্য করা হবে, আর যদি কখনো তারা নিজেদের আত্মার প্রতি জুলুম করে, তখন হে মাহবুব! (তারা) আপনার দরবারে হাজির হয়, অতঃপর আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে, আর রাসুল তাদের পক্ষে সুপারিশ করেন, তবে অবশ্যই তারা আল্লাহকে অত্যন্ত তওবা কবুলকারী, দয়ালু পাবে। ৬৫. সুতরাং হে মাহবুব! আপনার রবের শপথ, তারা মুসলমান হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত পরস্পরের ঝগড়ার ক্ষেত্রে আপনাকে বিচারক মানবে না, অতঃপর যা কিছু আপনি নির্দেশ করবেন, তাদের অন্তরে সে সম্পর্কে কোন দ্বিধা পাবেনা এবং সর্বান্তঃকরণে তা মেনে নেবে। (সূরা নিসা, আয়াত-৬৪,৬৫)

উপরোক্ত আলোচনায় এ কথা স্পষ্ট প্রতিয়মান যে, নবী প্রেম হলো ঈমানের মূল। নবীজির (সাঃ) শাফাআত ছাড়া কেউ কোন কিছু অর্জন করবে না। তরিকতের জগৎ এ সাধনার একটি স্তর রয়েছে, যার নাম ফানাফির রাসুল অর্থাৎ প্রতিটি কাজে নবী মুহাম্মদ (সাঃ)-এর প্রতি মহব্বত থাকতে হবে। রাসুল (সাঃ)-এর মহব্বত ছাড়া ফানাফির রাসুল অর্জন করা সম্ভব নয়। সাহাবী (রাঃ) গণ রাসুল (সাঃ) কে নিজেদের প্রাণের চেয়ে বেশী ভালোবাসতেন। হিজরত করতে হবে বলে হযরত আবু বকর (রাঃ) কে রাসুল (সাঃ) আদেশ দিয়েছিলেন এবং তাকে হিজরতের সাথী হতে হবে বলে জানিয়েছিলেন। সেদিন থেকে হযরত আবু বকর (রাঃ) দীর্ঘ কয়েক মাস নবী (সাঃ)-এর মহব্বতে বিছানাতে ঘুমাতে যাননি। তাঁর মনে সব সময় ভয় বা চিন্তা ছিলো, নবী (সাঃ) যেন তাকে ডেকে ফিরে না যান। এছাড়া ইতিহাসে দেখা যায়, হযরত আলী (আঃ) নিজের জীবনের মায়া ত্যাগ করে রাসুল (সাঃ)-এর হিজরতের সময় রাসুল (সাঃ)-এর নিরাপদে মদিনা গমন নিশ্চিত করতে মুহাম্মদ (সাঃ)-এর বিছানা মুবারকে চাদর দ্বারা নিজেকে আবৃত করে শুয়ে ছিলেন। নবী মুহাম্মদ (সাঃ)-এর প্রেমের অসংখ্য নজির ইসলামের ইতিহাসে পাওয়া যাবে। আল্লাহ স্বয়ং প্রতি মুহুর্তে দরূদ পড়েন রাসুল (সাঃ)-এর প্রতি এবং মহা পরাক্রমশালী আল্লাহ কোন কিছুই সৃষ্টি করতেন না যদি না রাসুল (সাঃ) কে সৃষ্টি করে মহিমান্বিত সৃষ্টিকর্তা তাঁর (সাঃ) শান, মান, মর্যাদা ও মাহাত্য সবার কাছে প্রকাশের ইচ্ছা না করতেন। এ জন্যই পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ বলেছেন,

قُل إِن كُنتُم تُحِبّونَ اللَّهَ فَاتَّبِعونى يُحبِبكُمُ اللَّهُ وَيَغفِر لَكُم ذُنوبَكُم وَاللَّهُ غَفورٌ رَحيمٌ ٌ

অর্থ: হে মাহবুব! আপনি বলে দিন, হে মানবকুল, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবেসে থাকো তবে আমার অনুসারী হয়ে যাও, আল্লাহ তোমাদেরকে ভালোবাসবেন এবং তোমাদের গুনাহ ক্ষমা করবেন; আর আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়ালু। (সূরা আল-ইমরান, আয়াত-৩১)

নবী করিম (সাঃ) স্বয়ং বলেছেন, “উত্তম গুণাবলীর পরিপূর্ণতা দানের জন্যই আমি প্রেরিত হয়েছি”। আর তওবা কবুলকারী আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেছেন,

لَقَد كانَ لَكُم فى رَسولِ اللَّهِ أُسوَةٌ حَسَنَةٌ لِمَن كانَ يَرجُوا اللَّهَ وَاليَومَ الءاخِرَ وَذَكَرَ اللَّهَ كَثيرًا ٌ

অর্থ: নিশ্চয় তোমাদের জন্য রাসুল (সাঃ)-এর অনুসরণ উত্তম, তারই জন্য, যে আল্লাহ ও শেষ দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহকে খুব স্মরণ করে। (সূরা আল-আহযাব, আয়াত-২১)