হাদিসের আলোকে পীর বা অলির মর্যাদা এবং প্রয়োজনীয়তা

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ আখেরী নবী রাসুলেপাক (সাঃ) তাঁর অনুপস্থিতিতে পরবর্তী উম্মতের কাছে তাঁর প্রতিনিধি পীর-মুর্শিদ বা অলি-আল্লাহদের গুরুত্ব, মর্যাদা এবং প্রয়োজনীয়তা বিবৃত করে জীবদ্দশাতেই দিকনির্দেশনা দিয়ে গেছেন। সেই মহাগুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা গুলো নিচে উল্লেখ করা হলোঃ

হুজুরেপাক (সাঃ) ইরশাদ করেন,

اِنَّ الْعُلَمَاءَ وَرَثَةُ الْأَنْبِيَاءُِ

অর্থ: আলেমগণ (হক্কানী আলেম তথা অলিগণ) নবীর ওয়ারিশ (প্রতিনিধি)। (তিরমিজি, আবু দাউদ, তাবরিযি)

নবী করিম (সাঃ) ইরশাদ করেন,

أَنَّ الْعُلَمَاءَ هُمْ وَرَثَةُ الْأَنْبِيَاءُِ

অর্থ: শুধু হক্কানী আলেমগণই হলেন নবীর ওয়ারিশ (প্রতিনিধি)। (বুখারি, ইবনে মাজাহ, আহমদ ইবনে হাম্বল)

নবীজি (সাঃ) ইরশাদ করেন,

من زار علما فكانما زارنىُُ

অর্থ: যে একজন হক্কানী আলেমকে দেখলো, সে নবীকে দেখলো। (হাকিকতে আউলিয়া)

রাসুল (সাঃ) ইরশাদ করেন,

من صلى خلف عالم تكين فكانما صلى خلف نبى مرسلُُ

অর্থ: একজন হক্কানী আলেম বা নায়েবে রাসুলের দিকে এক নজর মহব্বতের সাথে তাকালে এক বছরের নফল রোযা ও নফল নামাযের চেয়ে বেশী ইবাদত গণ্য হবে। (হাকিকতে আউলিয়া)

হুজুর আকরাম (সাঃ) ইরশাদ করেন,

من صلى خلف عالم تكين فكانما صلى خلف نبى مرسل ُ

অর্থ: যে ব্যক্তি কোন মুত্তাকী আলেমের পিছনে নামায আদায় করলো, সে যেন আল্লাহর রাসুলের (সাঃ) পেছনে নামায আদায় করলো। (হাকিকতে আউলিয়া)

শেষ নবী (সাঃ) ইরশাদ করেন,

يشفع يوم القيامة ثلاثة الأنبياء، ثم العلماء، ثم الشهداءُُ

অর্থ: কেয়ামতের দিন তিন শ্রেণীর লোক শাফাআত করবেন- নবী, হক্কানী আলেম বা নায়েবে রাসুল এবং শহীদগণ। (ইবনে মাজাহ, হাদিস-৪৩১৩)

বিশ্বনবী (সাঃ) ইরশাদ করেন,

الشيخ فى اهله كالنبى فى امتهُُ

অর্থ: মুর্শিদ বা পীর তাঁর আহল বা মুরিদের কাছে তেমন, যেমন একজন নবী তার উম্মতের কাছে। (জামেউস সগীর, ঈমাম জালালউদ্দিন সূয়ুতি, ২/৯০ পৃষ্ঠা; ঈমাম ইবনে হিব্বান, মাজরুহীন, ২/৩৯ পৃষ্ঠা, হাদিস-৫৭১; জালালউদ্দিন সূয়ুতি, জামিউল আহাদিস, ১৩/৪৫৫ পৃষ্ঠা, হাদিস-১৩৫১৬)

নবী করিম (সাঃ) ইরশাদ করেন,

المؤمن ينظر بنور الله تعلى عز وجل الذي خلق منهُُ

অর্থ: মুমিন বান্দাগণ আল্লাহর নূর দ্বারা দেখে যে নূর দ্বারা তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে। (আল-ফিরদাউস, ঈমাম দায়লামী-৪/১৭৮, হাদিস-৬৫৫৪; কাশফুল খাফা, ঈমাম আযলুনী-২/৩৯৬, হাদিস-২৭০০)। এ হাদিসটি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। হযরত ঈমাম গাজ্জালী (রঃ) “দাকায়েকুল আখবার” গ্রন্থে বর্ণনা করেন, মহান আল্লাহ স্বীয় নূর মুবারক হতে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর নূরকে সর্বপ্রথম সৃষ্টি করেন। পরে নূরে মুহাম্মদী (সাঃ) থেকে সমস্ত জগৎ এবং জগৎ-এর ভেতরের সবকিছু সৃষ্টি করা হয়, অর্থাৎ মুমিনের ক্বলবও এ পবিত্র নূর মুবারক থেকে সৃষ্টি যা দ্বারা সে দেখে।

হুজুর আকরাম (সাঃ) ইরশাদ করেন,

قَلْبُ الْمُؤْمِنِ عَرْشُ اللهُِ

অর্থ: মুমিন বান্দার ক্বলব হলো আল্লাহর আরশ। (১. ঈমাম সাখাভী, মাকাসিদুল হাসানা, পৃষ্ঠা-৪২৯, হাদিস-৯৮৮; ২. আজলুনী, কাশফুর খাফা, পৃষ্ঠা-২/১৯৫, হাদিস-২২৫৪; ৩. মকতুবাত শরীফ)

রাসুলেপাক (সাঃ) ইরশাদ করেন, “নিশ্চয় মহান আল্লাহতায়ালা আসমানসমূহকে খুলে দিয়েছেন হিযকিল নামক এক ফেরেশতার জন্য। তিনি আরশ পর্যন্ত দেখতে পেলেন এবং বললেন, আল্লাহ তুমি পাক পবিত্র, তোমার শান মহান। অতঃপর আল্লাহ বললেন, নিশ্চয় আসমানসমূহ ও আরশ দূর্বলতা প্রকাশ করছে আমাকে স্থান দিতে কিন্তু মুমিনের ক্বলব বা অন্তর ন¤্রতা প্রকাশ করে আমাকে গ্রহণ করেছে”। (ঈমাম আহমদ ইবনে হাম্বল, কিতাবুল যুহুদ, পৃষ্ঠা-১/৬৯, দারুল কুতুব ইলমিয়াহ, বৈরুত, লেবানন)। এ হাদিসটি হযরত ওহ্হাব ইবনে মুনাব্বাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত।

নবী করিম (সাঃ) ইরশাদ করেন,

سئل عن رسول الله (ص) ين بيت الله قال رسول الله (ص) فى قلوب المؤمنينُُ

অর্থ: রাসুল (সাঃ) কে প্রশ্ন করা হয়েছিলো, আল্লাহর বাড়ী কোথায়? তিনি উত্তর দিলেন মুমিনের ক্বলবের ভেতর। (হাকিকতে আউলিয়া)

নবীজি (সাঃ) ইরশাদ করেন,

الْمُؤْمِنُ اَعْظَمُ حُرْمَةً مِنَ الْكَعْبَةِ ُ

অর্থ: মুমিন ব্যক্তি কাবা শরীফ হতেও অধিক সম্মানী। (ইবনে মাজাহ)

হাদিসে কুদসীতে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন,

مَنْ عَادَى لِيْ وَلِيًّا فَقَدْ اۤذَنْتُهُ بِالْحَرْبُِ

অর্থ: যারা আমার অলির বিরোধীতা করে, আমি আল্লাহ তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করছি। (বুখারি শরীফ, কিতাবুর রিকাক)

হাদিসে কুদসীতে নবীজি (সাঃ) ইরশাদ করেন,

الفقر فخرى والفقرمنى ُ

অর্থ: ফকিরি আমার গর্ব এবং ফকির আমার থেকেই। (সিররুল আসরার, হযরত আব্দুল কাদের জিলানী রঃ)

হাদিসে কুদসীতে দয়াময় আল্লাহ ইরশাদ করেন,

محبتى محبت الفقراء ُ

অর্থ: ফকিরদের প্রেমই আমার (আল্লাহ) প্রেম। (সিররুল আসরার, হযরত আব্দুল কাদের জিলানী রঃ)

পরিশেষে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, খাঁটি ইসলাম গ্রহণ করতে হলে অবশ্যই হক্কানী আউলিয়া সন্ধান করতে হবে, তাঁর কাছে বায়আত হয়ে তরিকা গ্রহণ করতে হবে। কারণ রাসুল (সাঃ) বলেছেন “আল ওলামাও মিন সাদরি” অর্থাৎ ওলামারা (হক্কানী আলেম বা মুর্শিদ) আমার সিনা থেকে। তাই যে মুর্শিদের রাসুলেপাক (সাঃ)-এর সিনা মুবারকের সাথে সম্পর্ক আছে তাঁর কাছে ইসলামে প্রবেশের বায়আত হলে ইহজীবনে ক্বলবে আল্লাহর নূর দেখার সৌভাগ্য হবে ফানাফিশ শায়খ, ফানাফির রাসুল, ফানাফিল্লাহর পর্যায়গুলো পাড়ি দেওয়ার মাধ্যমে। মহান আল্লাহতায়ালা পাক কুরআনে বলেছেন,

وَمَن كانَ فى هٰذِهِ أَعمىٰ فَهُوَ فِى الءاخِرَةِ أَعمىٰ وَأَضَلُّ سَبيلًُ

অর্থ: যে ব্যক্তি এ জীবনে অন্ধ (যে ক্বলব আল্লাহর পবিত্র নূরের সন্ধান পায়নি) হয়, সে পরকালেও অন্ধ এবং আরো বেশী পথভ্রষ্ট। (সূরা বনী ইসরাইল, আয়াত-৭২)

এজন্য বিশ্ববিখ্যাত আউলিয়া মওলানা জালালুদ্দিন রুমী (রঃ) মসনবী শরীফে বলেছেন, তুমি যদি আল্লাহর সাথে উঠাবসা করতে চাও, তবে আল্লাহর অলিদের মজলিসে বস। তিনি মসনবী শরীফে আরো লিখেছেন, তোমার অন্তর যদি পাষানের মত শক্তও হয়, আর তুমি কোন কামেল লোকের সংশ্রব অবলম্বন কর, তবে পরশপাথরের ছোঁয়ায় যেরূপ লোহা সোনায় পরিণত হয়, তেমনি তোমার দিলও গওহর বা অমূল্য রত্ন হয়ে উঠবে। হযরত রুমী (রঃ) মসনবী শরীফে আরো লিখেছেন, তুমি সত্ত¡র কামেলে মোকাম্মেল আউলিয়ার দামন ধর, তবে আখেরী জামানার ফেৎনা হতে রক্ষা পাবে।