নক্শবন্দি মোজাদ্দেদিয়া তরিকায় মুর্শিদে কামেল খোদা প্রাপ্তির পথের সন্ধান দেন। তাই সাধকগণকে পীরের প্রতি আদব মহব্বত এবং প্রগাঢ় বিশ্বাস স্থাপন করে তরিকতের পথে অগ্রসর হতে হবে। অন্যথায় প্রকৃত পথের সন্ধান মিলবে না। পীরের সন্তুষ্টি ব্যতীত মুরিদের আত্মিক উন্নতির নজির নাই। বিনয়ী ও ভদ্র ব্যবহারকারীকে আল্লাহ পছন্দ করেন। তাই মহাপ্রভুর নৈকট্য লাভ করতে হলে আদব শিক্ষার প্রয়োজন।
নিম্মে আদব রক্ষার কতিপয় নির্দেশনা প্রদত্ত হলোঃ
১. হক্কানী পীর লাভ হলে মুরিদ তার নিজ মতলব (উদ্দেশ্য) পীরের নিকট প্রকাশ করবে, অর্থাৎ বলবে যে, “আমি আপনার খেদমতে আল্লাহর মারেফত শিক্ষা করতে এসেছি”। পীর যদি দয়া করে কবুল করেন, তবে আর কিছু বলতে হবে না বা সবকাদী চাওয়া চলবে না। পীর কিছু তালিম দিলে একান্ত মনোযোগের সাথে তা আদায় করতে থাকা মুরিদের পক্ষে বিশেষ জরুরী। সর্বদা পীরের দিকে মনোনিবেশ রাখতে হবে।
২. পীর যা আদেশ করেন বিলম্ব না করে তখনই পালন করা কর্তব্য। পীরের কার্যে বা আদেশের প্রতিবাদ করা মুিরদের জন্য জহরে কতল এবং জীবন বিনাশকারী বেয়াদবি।
৩. পীরের সাথে কোন প্রকার বাদানুবাদ বা তর্ক-বিতর্ক করা যাবে না। কারণ পীরের সাথে বাদানুবাদ ও তর্কের দ্বারা মুরিদের দিলে পর্দা পতিত হয়। এর কোন প্রতিকার নেই। এতে মুরিদের ফায়েজ প্রাপ্তি বন্ধ হয়ে যায়।
৪. মুরিদের নিজের বাতেনী হালাতসমূহ পীরকে জানাবে, কেননা মুর্শিদ বাতেনী হাকিম।
৫. পীর ক্ষমতাবলে মুরিদের অবস্থা জ্ঞাত আছেন, তথাপি মুরিদের নিজ অবস্থা পীরকে প্রকাশ্যে জানাবে।
৬. মারেফত লাভ করতে হলে একান্ত ভাবে পীরের দামন (আঁচল) ধরতে হবে। কোন কষ্ট, মুসিবত গ্রাহ্য করা যাবে না; জান-মাল, সন্তান-সন্ততি ও যাবতীয় দুনিয়াবি প্রিয় বস্তুর চেয়ে পীরকে বেশি মহব্বত করতে হবে। কারণ কামেল পীরের মহব্বত ব্যতীত আল্লাহ ও রাসুল (সাঃ) এর মহব্বত লাভ হবেনা।
৭. পীরের বিনা অনুমতিতে তাঁর সকল আদব ও অভ্যাসের অনুসরণ করবে না। কেননা পীর ও মুরিদে বহু পার্থক্য। পীর যা করার আদেশ করেন বিনা দ্বিধায় কেবল তাই করা উচিত।
৮. মুরিদ নিজেকে সকলের চেয়ে নিকৃষ্ট ও হীন মনে করবে।
৯. শুধুমাত্র আল্লাহতায়ালার মহব্বত ব্যতীত পীরের নিকট অন্য কিছু প্রত্যাশা করা যাবেনা। পীরের হাতে মুরিদ এমন ভাবে থাকবে যেরূপ গোসলকারীর হাতে মৃত ব্যক্তি।
১০. কোন কোন সময় বাহ্যত মুরিদের কথা সত্য দেখা গেলেও পীরের কথাকেই সত্য বলে জানতে হবে। কেননা কামেল পীর খোদার নির্দেশ ব্যতীত কোন কাজ করেন না। তাই প্রকৃত বিষয় আল্লাহ ও আল্লাহর পছন্দের ব্যক্তিগণ ব্যতীত আর কেউ বেশী জানেন না।
১১. পীরের কোন খলিফা বা অগ্রগামী জাকের ভাইকে মুরুব্বির ন্যায় সম্মান করতে হবে।
১২. নিজের যাবতীয় কাজ পীরের নিকট জিজ্ঞাসা করতে হবে। পীরের বিনা হুকুমে কোন কাজ করা মুরিদের পক্ষে চরম বেয়াদবি।
১৩. মুরিদ নিজ পীরের প্রতি এরূপ আস্থা রাখবে যে নিজ পীরের ওসিলায় যাবতীয় মকসুদ হাসিল হবে। নিজ পীর ব্যতীত অন্যের কোন প্রকার সাহায্যের প্রত্যাশী হওয়া মুরিদের পক্ষে ক্ষতিকর।
১৪. পীরের যাবতীয় কাজকর্ম ও আদেশ নিষেধে সর্বোতভাবে রাজি থাকতে হবে এবং জান ও মালের দ্বারা পীরের খেদমত করতে হবে।
১৫. সর্বপ্রকার কাজে পীরের ইচ্ছার নিকট মুরিদ নিজ ইচ্ছাকে তুচ্ছ মনে করবে।
১৬. পীরের নিকট কোন কথা জিজ্ঞাসা করে উত্তর তলব করা ভয়ানক বেয়াদবি।
১৭. পীর কোন কথা জিজ্ঞাসা করা মাত্র মুরিদ আদবের সাথে উত্তর দিবে। পীরের সাথে সময় বুঝে নিজ জিজ্ঞাসা অতি বিনয়ের সাথে উপস্থাপন করতে হবে।
১৮. পীর কথা বলতে থাকলে মুরিদের উচিত কোন কথা না বলা বরং একনিষ্ঠ ভাবে তা শ্রবণ করা।
১৯. পীরের সামনে অতি বিনীত ভাবে দন্ডায়মান থাকতে হয়। পীরের দরবারে কোন প্রকার উদ্ধত আচরণ করা বদনসিবীর লক্ষণ। ওলিয়ে কামেলদের বাসস্থান হামেসা আল্লাহর রহমত পূর্ণ থাকে। মুরিদের সর্বপ্রধান কর্তব্য পীরের দরবারের আদব রক্ষা করে চলা।
২০. নিজের ছায়া পীরের উপর পড়ে কিংবা পীরের ছায়া নিজের উপর পড়ে, এমন স্থানে দাঁড়ানো বা হাঁটা চরম বেয়াদবি। পীরের ব্যবহার্য আসবাব যেমনঃ থালা-বাসন, গ্লাস, কাপড়, ছড়ি, কুরশী, জায়নামায ও জুতা ব্যবহার করা গর্হিত অপরাধ ও আদব না করা মুরিদের জন্য মহাবিপদজনক।
২১. পীরের সম্মুখে পানাহার করা, পীরের দিকে পা লম্বিত করা, পীরের মাজার ও হুজরা শরীফের দিকে পা লম্বিত করা, কথা বলা ও অহংকার ও গৌরব প্রকাশ করা মুরিদের জন্য ভয়ানক বেয়াদবি । পীরের সম্মুখে অন্যের সাথে কথা বলা, হাসাহাসি করা, জুতা ব্যবহার করা, ছাতা ব্যবহার করা নিষিদ্ধ।
২২. পীরের দরবারের সীমানায় উচ্চ স্বরে কথা বলা, কোন কারণে রাগ বা গোস্বা প্রকাশ করা, অন্ধ বংশ ও বিদ্যার গৌরব দেখানো জাকেরের লক্ষণ নয়।
২৩. জিকিরের মজলিসে পবিত্রতা রক্ষা করা, মজলিসে হাঁটু মুড়ে নামাযের কায়দায় বসা জাকেরের কর্তব্য। মজলিসে ধূমপান করা, উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করা, অমনোযোগী থাকা নিষিদ্ধ।
এছাড়া খোদার প্রকৃত করুণা ও নৈকট্য লাভ করতে হলে মনুষ্য স্বভাবের দুষিত গুণসমূহ পরিত্যাগ করে ফেরেশতা ও সৎ মানুষের গুণের অনুকরণ করা, দুষিত গুণগুলো প্রত্যেকটি দিল বা ক্বলব থেকে বের করে দেয়া এবং সে স্থানে আল্লাহর মহব্বত কায়েম করা অর্থাৎ সর্বপ্রকার কুকর্ম পরিত্যাগ করা একান্ত অপরিহার্য।