ইসলাম

ইসলাম আরবি ভাষার শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ আনুগত্য করা, আত্মসমর্পণ করা বা শান্তির পথে চলা। সংক্ষেপে আল্লাহ ও রাসুল (সাঃ) এর আনুগত্য করাকে ইসলাম বলে। ইসলাম আল্লাহর মনোনীত সর্বশেষ ধর্ম যার নবী রাসুলেপাক হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এবং সংশ্লিষ্ট আসমানি কিতাব আল-কুরআন। ব্যাপক অর্থে ইসলামের প্রকৃত অর্থ আল্লাহর নামে আত্মবিসর্জন এবং তাঁর বিধি-নিষেধ প্রতিপালন করে রাসুল প্রেমে সিক্ত হয়ে মানুষের জাগতিক ও আধ্যাত্মিক কল্যাণে আত্মনিয়োগ করা।

একটি হাদিসে নবী মুহাম্মদ (সাঃ) সুন্দর ভাবে ইসলামের মূল পরিচয় তুলে ধরেছেন,

بُنِىَ الْاِسْلَامُ عَلٰى خَمْسٍ شَهَادَةِ اَنْ لَّاۤ اِلٰهَ اِلَّا اللهُ وَاَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهٗ وَرَسُوْلُهٗ وَاِقَامِ الصَّلٰوةِ وَاِيْتَاءِ الزَّكٰوةِ وَالْحَجِّ وَصَوْمِ رَمَضَان ُ

অর্থ: ইসলাম পাঁচটি ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। এই সাক্ষ্য দেয়া যে, আল্লাহ ব্যতীত আর কোন মাবুদ নেই, মুহাম্মদ (সাঃ) আল্লাহর বান্দা ও রাসুল এবং সালাত কায়েম করা, যাকাত প্রদান করা, হজ করা এবং রমজানের রোযা রাখা। (বুখারি, মুসলিম)

মহান আল্লাহ মানুষের হেদায়েতের জন্য অনেক ধর্ম বা বিধি-বিধান আদম (আঃ) এর সময় থেকে নাযিল করেছেন। এ সকল ধর্ম এবং বিধি-নিষেধের সর্বশেষ ও পূর্ণাঙ্গ রূপ হলো ইসলাম। আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেছেন,

إِنَّ الدّينَ عِندَ اللَّهِ الإِسلٰمُ َ

অর্থ: নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট ইসলামই (একমাত্র) মনোনীত ধর্ম। (সূরা আল-ইমরান, আয়াত-১৯)

ইসলাম মানব জাতির জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি বিশেষ নিয়ামত। এটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। মানব জীবনের সকল বিষয় ও সমস্যার পরিপূর্ণ সমাধানের দিকনির্দেশনা এ ইসলামে দেয়া হয়েছে। মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু, রূহের সৃষ্টি ও রূহ জগৎ এবং আখেরাতের বিষয়গুলো পূর্ণাঙ্গ ভাবে ইসলামে বর্ণিত হয়েছে।

ইসলামী বিধি-বিধান মেনে চললে মানুষ দুনিয়া ও আখেরাতে পরিপূর্ণ শান্তিময় জীবন লাভ করতে পারে। এ জন্য ইসলামকে শান্তির ধর্ম বলা হয়। ইসলাম সর্বজনীনও। ইসলাম কোন কাল, অঞ্চল বা জাতির জন্য সীমাবদ্ধ নয়। অন্যান্য ধর্মের নামকরণ সে সব ধর্মের প্রবর্তক, প্রচারক, অনুসারী কিংবা জাতির নামে করা হয়েছে। কিন্তু ইসলাম সর্বজনীন ধর্ম হওয়ার কারণে এর নামকরণ কারও নামে করা হয়নি। বরং আল্লাহ ও রাসুল (সাঃ)-এর আনুগত্যের মাধ্যমে সঠিক ও সরল পথে জীবন পরিচালনা করার জন্য এ ধর্মের নাম ইসলাম হয়েছে।

মানুষের জীবনে ইসলামের চাইতে শান্তির প্রশস্ত পথ আর নেই। মহান আল্লাহর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষ। মানুষের মনুষ্যত্ব তথা মানবতার পূর্ণতা লাভের একমাত্র আদর্শ ইসলামই পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করেছে যা ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত।

ইসলাম একেশ্বরবাদী ধর্ম। এতে আল্লাহর কোন শরীক নেই। ইসলামের উদারতা প্রকৃতই অতুলনীয়। মুসলমানদের নির্দিষ্ট কোন সম্প্রদায় নেই। প্রত্যেক মুসলমানই এক আল্লাহর উপাসক, এক জাতি এবং এক পরিবারভূক্ত ধরা হয়। ইসলাম ধর্মের অনুশাসনে পৃথিবীর প্রত্যেক মুসলমানই আত্মীয় এবং প্রত্যেকেই প্রত্যেকের প্রীতি-ভালোবাসার পাত্র। যে কোন একেশ্বরবাদী, সৎকর্মশীল এবং পরকালে বিশ্বাসী ব্যক্তিই মহান আল্লাহর দরবারে পুরস্কৃত হবেন, এটা একমাত্র মহান ধর্ম ইসলামেরই উদারতা এবং প্রশস্ততা।

ইসলাম ধর্মে নিম্মোক্ত বিষয়গুলো নিষিদ্ধ বা হারাম:-

  • দেব-দেবীর উপাসনা
  • সুদ
  • অমিতব্যয়িতা
  • মূর্তি পূজা ও মানব পূজা
  • কুশীদ গ্রহণ
  • জাল করা
  • জুয়া খেলা
  • পরচর্চা
  • জুয়াচুরী
  • মদ্যপান
  • পরনিন্দা
  • মিথ্যা
  • বাহ্যিক আমোদ-প্রমোদ
  • হত্যা
  • প্রবঞ্চনা
  • গান এবং বাদ্য
  • নরবলি
  • পর সম্পদ বা দ্রব্য হরণ
  • অবিচার
  • যাদু ও ডাকিনী বিদ্যা
  • বেপর্দা হওয়া
  • অত্যাচার
  • ধর্ষণ
  • বেশ্যাবৃত্তি
  • অনাচার
  • পরশ্রীকাতরতা
  • ঘুষ

“লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ” অর্থাৎ এক আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নাই এবং মুহাম্মদ (সাঃ) আল্লাহর রাসুল, এটাই ইসলামে বায়আত গ্রহণের বা ইসলামে প্রবেশের মূলমন্ত্র যাকে কালেমা তয়্যেবা বলে। ইসলামে আছে শুধু এক আল্লাহর উপাসনা, বিশ্বপ্রেম, সাম্য, মৈত্রী এবং ভ্রাতৃত্বভাব। কালেমা (ঈমান আনা), নামায, রোযা, হজ এবং যাকাতই ইসলামের মূল উপাদান। ইসলামের বাহ্যিক অংশ শরীয়ত এবং অভ্যন্তরীণ অংশ হলো তাছওয়াফ বা আধ্যাত্মিকতা। উভয় মিলেই ইসলাম পূর্ণতা লাভ করেছে। হযরত আদম (আঃ) হতে হযরত ঈসা (আঃ) পর্যন্ত যে একেশ্বরবাদী ধর্ম চলে আসছিলো, রাসুলেপাক (সাঃ)-এর সময় পরিপূর্ণ সংস্কার সাধন পূর্বক পূর্ণতা লাভ করে জগতে প্রকাশিত হয়। ইসলাম ধর্মে ঐশী প্রেম প্রবল। নবী করিম (সাঃ), তাঁর বংশধরগণ, সাহাবীগণ এবং আউলিয়াগণ এ ঐশী প্রেমের বলেই অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন এবং অসংখ্য মোজেজা ও কেরামত দেখাতে সমর্থ হয়েছেন। ইসলামে বিভিন্ন ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা ও পবিত্র আত্মা সম্পর্কে কোনরূপ অসম্মান প্রদর্শন সমর্থন করে না এবং কারো প্রতি কোনরূপ কুবাক্য প্রকাশ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। ইসলাম শিক্ষার বিশেষত্ব এবং অপূর্ব সৌন্দর্য এই যে, পৃথিবী সৃষ্টি হবার পর থেকে বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন জাতির মধ্যে যে সকল ঈশ্বরভাবাবিষ্ট ধর্ম প্রচারক বা উপদেষ্টা জন্মগ্রহণ করেছেন তারা সকলেই সম্মানের পাত্র এবং কোন ধর্মই মিথ্যার উপর প্রতিষ্ঠিত নয়। বল প্রয়োগপূর্বক ধর্মান্তরের চেষ্টা ইসলামের নীতি বিগর্হিত। উদারতা, বিশ্বপ্রেম এবং বিশ্বভ্রাতৃত্ব ইসলামের অনন্য বৈশিষ্ট্য।

ইসলামের আর একটি বিশেষত্ব এই যে, ইসলামে স্বধর্মী এবং বিধর্মী সকলকেই ভালোবাসতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে কারণ সকলেই এক আল্লাহর সৃষ্ট আর ইসলাম ধর্মের অনুশাসনে প্রত্যেক মানুষই মুসলমানদের প্রীতি ও ভালোবাসার পাত্র। কোন মানুষই মুসলমানদের ঘৃণার পাত্র নয়। রাসুলেপাক (সাঃ) তাঁর ভক্ত মুসলমানদের আদেশ দিয়েছেন, বিপক্ষ শত্রু কর্তৃক যতক্ষণ কোন মুসলমান আক্রান্ত না হবে ততক্ষণ সে শত্রুকে আঘাত করতে পারবে না, অর্থাৎ শুধুমাত্র আত্মরক্ষার্থে মুসলমানগণ বিপক্ষ দল বা শত্রুকে আঘাত করতে পারবে।

ইসলামের গণতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্যের কারণে এ ধর্ম এত সফলতা লাভ করেছে। ইসলাম জাতি, ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে প্রত্যেক মানুষকে এ ধর্ম গ্রহণ করতে আহবান করে। সকল মানুষই যে মহান আল্লাহর উপাসনা করার এবং সেবক হবার যোগ্যতা রাখে, তা ইসলাম মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করে। মানুষে মানুষে ইসলাম কোনরূপ পার্থক্য করে না। বিশেষ ভাবে মসজিদে মুসলমানদের মধ্যে উচ্চনীচ ভেদে কোনরূপ পার্থক্য করা হয়না। বিশ্ব প্রভুর দৃষ্টিতে সকল মানুষ যে সমান তা মুখে স্বীকার করলেও অন্যান্য ধর্মের উপাসনালয়ে এই নীতির ব্যতিক্রম দেখা যায়। স্বর্গীয় পিতৃত্ব এবং বিশ্বজনীন ভ্রাতৃত্বের প্রতীক ইসলাম পৃথিবীর বহু অসভ্য দেশ হতে নৃশংস আচরণ বিদূরিত করতে সমর্থ হয়েছে এবং অযুত সহস্র মানুষকে উন্নত জীবনযাপন করার শিক্ষা দিয়েছে এবং দিচ্ছে। ইসলাম পশ্চাৎপদ ও অন্ধকারে নিমজ্জিত বহু জাতিসমূহকে জড় উপাসনা পরিত্যাগ করাতে সক্ষম হয়েছে।

ইসলামে দুটি উৎসব বা পর্ব বিশ্ববিখ্যাত। একটি রমজান মাসের শেষে ঈদুল ফিতর এবং অপরটি দশ জিলহজ তারিখে অনুষ্ঠিত ঈদুল আজহা। ঈদুল আজহার দিনে বিশ্বের সকল সামর্থ্যবান মুসলমানই আল্লাহর উদ্দেশ্যে হালাল পশু কোরবানী করে। মুসলমানদের পানাহার, পোশাক-পরিচ্ছদ সবই কুরআন এবং হাদিস অনুযায়ী হয়ে থাকে।

সকল আদম সন্তানই সমান মর্যাদাবান। কিন্তু চরিত্রের পবিত্রতা রক্ষার জন্য একেকজন অন্যজন হতে শ্রেষ্ঠ। নবী করিম (সাঃ) বলেছেন, “বংশ গৌরবের স্থান ইসলামে নেই; তারা যে বংশ বা যে দেশের লোক হোক না কেন, যদি চরিত্রবান ও সংযমী হয় তবে তারাই আমার পরম আত্মীয়”। সকলকেই চরিত্রবান হতে হবে অন্যথায় মহান আল্লাহ তাদেরকে লাঞ্ছিত করবেন। সূরা আল-হুজরাত এর ১৩ নং আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন,

إِنَّ الدّينَ عِندَ اللَّهِ الإِسلٰمُ َ

অর্থ: নিশ্চয় আল্লাহর নিকট তোমাদের মধ্যে অধিক সম্মানিত সে-ই, যে তোমাদের মধ্যে অধিক আল্লাহভীরু।

অর্থাৎ ইসলামে যার ক্বলবে যত বেশী আল্লাহ ভয় এবং তাকওয়া, সে মহান আল্লাহ এবং রাসুলেপাক হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর নিকট অধিক মর্যাদাশীল, যা মহান এ সত্য ধর্মের এক অনন্য সাধারণ বৈশিষ্ট্য। রাসুল (সাঃ) এর বিদায় হজের দিন আরাফাহ দিবসে পবিত্র জুম্মাবারে সাত আসমান-যমীনের একমাত্র অধিপতি দয়াময় আল্লাহ নিম্মোক্ত আয়াত নাযিল করেন-

اليَومَ أَكمَلتُ لَكُم دينَكُم وَأَتمَمتُ عَلَيكُم نِعمَتى وَرَضيتُ لَكُمُ الإِسلٰمَ دينًا ُ

অর্থ: আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং তোমাদের উপর আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম আর তোমাদের জন্য ইসলামকে দ্বীন মনোনীত করলাম। (সূরা মায়েদা, আয়াত-৩)

পরিশেষে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, ইসলামই বর্তমান থেকে কেয়ামত পর্যন্ত আল্লাহর মনোনীত সর্বশেষ, সর্বশ্রেষ্ঠ এবং পরিপূর্ণ ধর্ম যার সুশীতল ছায়াতলে আমজনতা নবী প্রেমে সমবেত হয়ে পূর্ণ মুমিন মুসলমানে পরিণত হতে পারে আর ধন্য করতে পারে অমূল্য মানবজন্মকে। আর স্বয়ং মহান আল্লাহ রূহের জগতে এই সার্বিক মহাপরিকল্পনা তৈরি করেছিলেন সকল কিছু সৃষ্টির আগে এবং জাগতিক ও আধ্যাত্মিক সবকিছুর বাস্তবায়নের দায়িত্ব দিয়েছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সর্বশেষ নবী রাসুলেপাক হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) কে।