যে জ্ঞানের সাহায্যে মানুষের সৎ গুণসমূহের প্রকারভেদ এবং অর্জনের পন্থা ও অসৎ গুণসমূহের শ্রেণীবিভাগ এবং তা থেকে আত্মরক্ষার উপায় অবগত হওয়া যায় তাকে এল্মে তাছওয়াফ বা এল্মে ক্বলব বলে। এল্মে তাছওয়াফ ইসলামে আধ্যাত্মিকতার সাথে সম্পর্কিত।
দোররি মুখতার গ্রন্থে আছে, “অবস্থা ভেদে এল্মে তাছওয়াফ শিক্ষা করা ফরযে আইন, কখনও ফরযে কিফায়া এবং কখনও মোস্তাহাব। যে পরিমাণ এল্মে তাছওয়াফের বা আখলাক শিক্ষার ফলে মানুষের চরিত্র বিশুদ্ধ ও মার্জিত হয়, ততটুকু শিক্ষা করা ফরযে আইন বা অবশ্য পালনীয়। আর যে পরিমাণ তাছওয়াফ শিক্ষার ফলে অন্যকেও শিক্ষা দেয়া যায়, সে পরিমাণ শিক্ষা করা ফরযে কিফায়া। আর যে পরিমাণ শিক্ষার ফলে এল্মে তাছওয়াফ সম্পর্কে অগাধ জ্ঞানের অধিকারী হওয়া যায়, উক্ত পরিমাণ শিক্ষা করা মোবাহ”।
মহান আল্লাহ শুধুমাত্র দুইটি মাখলুকাতকে তার ইবাদতের জন্য সৃষ্টি প্রসঙ্গে ইরশাদ করেন,
وَما خَلَقتُ الجِنَّ وَالإِنسَ إِلّا لِيَعبُدونٌِ
অর্থ: আমি জি¦ন ও ইনসানকে কেবল আমার ইবাদত করার জন্য সৃষ্টি করেছি। (সূরা আযযা-রিয়াত, আয়াত-৫৬)
মহান আল্লাহ আবার খাঁটি ভাবে তার ইবাদত করার জন্য জরুরী তাগিদ দিয়ে ঘোষণা করেছেন,
هُوَ الَّذى بَعَثَ فِى الأُمِّيّۦنٌَ
অর্থ: অনন্তর তুমি খাঁটি ভাবে আল্লাহর ইবাদত করো, তাঁরই জন্য ইবাদত। (সূরা আয যুমার, আয়াত-২)
সুফীগণ বলেন, বান্দারা যেন খাঁটি ইবাদতের ক্ষেত্রে জান্নাত লাভ এবং দোজখ থেকে বাঁচার নিয়ত না করে, শুধু মহান রবকে সন্তুষ্টির নিয়ত করে। সেই পরম পবিত্র খোদাতায়ালার ইবাদত খাঁটি ভাবে করার জন্য দুই প্রকার এল্ম নির্দিষ্ট হয়েছে। একটি এল্মে ফেকাহ বা জাহেরী শরীয়ত আর একটি এল্মে তাছওয়াফ। এই দুই এল্মের শিক্ষা করা স্ত্রী-পুরুষ উভয়ের প্রতি ফরয। এল্ম শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে রাসুলেপাক (সাঃ)-এর আদেশ এখানে বিশেষ ভাবে প্রণিধানযোগ্যঃ
طَلَبُ الْعِلْمِ فَرِيْضَةٌ عَلٰى كُلِّ مُسْلِمٍ وَّمُسْلِمَةٍ ٌ
অর্থ: প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্য এল্ম শিক্ষা করা ফরয। (মেশকাত)
বড় পীর হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রঃ) এ এল্মকে এল্মে জাহির বা প্রকাশ্য জ্ঞান এবং এল্মে বাতেন যা অন্তরের জ্ঞানের সাথে সম্পর্কিত বলে উল্লেখ করেছেন। এ সম্পর্কে রাসুলেপাক (সাঃ) বর্ণনা করেছেন,
عَنْ الحسن رضى الله عنه قال : العلم علمان، فعلم القلب فذلك العلم النافع ـ وعلم على اللسان فذلك حجة الله عز وجل على ابن آدم ٌ
অর্থ: হযরত হাসান (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত, এল্ম দুই প্রকারঃ প্রথমটি হলো এল্মে তাছওয়াফ বা অন্তরের এল্ম এবং এটা সবচেয়ে উপকারী এল্ম। দ্বিতীয়টি বাহ্যিক বা মৌখিক এল্ম, যা বনী আদমের উপর মহাসম্মানিত ও মহাপ্রতাপশালী আল্লাহতায়ালার দলিল স্বরূপ। (মেশকাত)
উপরের হাদিসের ব্যাখ্যায় মোল্লা আলী ক্বারী (রঃ) তাঁর বিশিষ্ট কিতাব “মিরকাত” এ লিখেছেন, “এল্ম দুই প্রকারঃ এল্মে শরীয়ত এবং এল্মে মারেফত”।
উপরোক্ত হাদিস দুটির আলোকে “তাফসিরে রূহুল বয়ান ও ছিবরুল আছরার” কিতাব দুটিতে এল্মে জাহির ও এল্মে বাতেন উভয় শিক্ষা অর্জন করাকে ফরয বলে উল্লেখ করা হয়েছে। হযরত শেখ আব্দুল হক (রঃ) বলেছেন, এল্মে বাতেন দ্বারা দিল বা ক্বলব জ্যোতির্ময় হয় ও দিলের পর্দা উঠে যায়। এল্মে জাহের ক্বলবে কোন তাছির করে না এবং তা দ্বারা ক্বলব জ্যোতির্ময় হয় না।
মোল্লা আলী ক্বারী (রঃ) এ প্রসঙ্গে তার অন্যতম কিতাব “মিরকাত” এর প্রথম খন্ডে লিখেছেন, “শরীয়তের বিধি-বিধান যথাযথ ভাবে প্রতিপালন না করলে মারেফত লাভ যেরূপ সম্ভবপর নয়; তদ্রƒপ এল্মে মারেফত যথাযথ ভাবে না শিখলে শরীয়তের হুকুম ও আহকাম ঠিক মত আদায় করা যায় না”। এজন্য ঈমাম মালেক (রঃ) বলেছেন, “যে ব্যক্তি কেবল তাছওয়াফের কাজ করলো কিন্তু শরীয়তের কাজ করলো না ঐ ব্যক্তি যিনদিক (কাফের) আর যে ব্যক্তি কেবল শরীয়তের কাজ করলো কিন্তু তাছওয়াফের কাজ করলো না ঐ ব্যক্তি ফাছেক। যে ব্যক্তি শরীয়ত ও তাছওয়াফ উভয়ই পালন করলো ঐ ব্যক্তি পুরা ঈমানদার”।
শরীয়ত যেমন শরীর এবং মারেফত হলো রূহ (আত্মা); তাই প্রকাশ্য শরীর না থাকলে রূহের কোন তুলনা করা যায় না আবার রূহ না থাকলে শরীরের কোন মূল্য নাই। এতদ্বসম্পর্কে আবু তালেব মক্কী (রাঃ)-এর বক্তব্য উল্লেখযোগ্য- “উভয় প্রকার বিদ্যাই আসল, একটি ব্যতীত অপরটি অসম্পূর্ণ। যেমনঃ ইসলাম বা ঈমান যা আখেরাতের সাথে সম্পৃক্ত; এ দুটির মধ্যে একটি দেহ (ইসলাম) আর অপরটি প্রাণ স্বরূপ (ঈমান)। এর একটির অভাবে মানুষ যেরূপ বাঁচতে পারেনা, সেইরূপ শরীয়ত ব্যতীত মারেফতের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না”।
এ দুই এল্মের একটিও যদি ত্যাগ করা হয় তবে কেয়ামতের দিন অন্ধ ও বদনছিব হয়ে মানুষ পুনুরুত্থিত হবে। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন,
وَمَن كانَ فى هٰذِهِ أَعمىٰ فَهُوَ فِى الءاخِرَةِ أَعمىٰ وَأَضَلُّ سَبيلًا ٌ
অর্থ: যে ব্যক্তি এ দুনিয়ায় অন্ধ হয়, সে পরকালেও অন্ধ হয়ে উঠবে এবং হবে আরো বেশী পথভ্রষ্ট। (সূরা বনী ইসরাইল, আয়াত-৭২)। অর্থাৎ হুজুরী ক্বলবের মারেফত বা এল্মে তাছওয়াফ হতে এ জীবনে যারা অন্ধ থাকবে, কেয়ামতের মাঠেও তারা ঐ বিষয়ে অন্ধ থাকবে এবং বেহেশত থেকে দূরে থাকবে। এ অন্ধত্ব দূর করতে রাসুলেপাক (সাঃ)-এর প্রত্যেক জামানার খাস প্রতিনিধির কাছে বায়আত হতে হবে। কারণ রোজ হাশরের দিনে মহান আল্লাহ প্রত্যেক সম্প্রদায়কে তার ঈমাম সহকারে আহবান করবেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহপাক ইরশাদ করেন,
يَومَ نَدعوا كُلَّ أُناسٍ بِإِمٰمِهِم ُ
অর্থ: স্মরণ কর সেই দিনকে যখন আমি প্রত্যেক সম্প্রদায়কে তাদের ঈমাম (নেতা) সহকারে আহবান করবো। (সূরা বনী ইসরাইল, আয়াত-৭১)
এ আয়াত থেকে স্পষ্ট যে, দুনিয়ার কোন নেক্কার বুজুর্গকে নিজের ঈমাম বানিয়ে নেয়া উচিত- শরীয়তের বেলায় তাক্বলীদ (মাযহাবের ঈমামের অনুসরণ) করে এবং তরিকতের বেলায় বায়আত (কামেলে মোকাম্মেল পীরের শীষ্যত্ব) গ্রহণ করে। যাতে হাশর নেক্কার ঈমামের সাথে হয়। যদি কারো নেক্কার সুন্নী ঈমাম না থাকে তবে তার ঈমাম হবে খোদ শয়তান। হায়াতে আছেন সহী সিলসিলার কোন কামেলে মোকাম্মেল পীর যিনি একটি মাযহাব অনুসরণ করেন শরীয়তের এবং যিনি এল্মে তাছওয়াফের পরিপূর্ণ জ্ঞান অর্জন করেছেন তাঁর মুর্শিদের কাছ থেকে, এমন একজনের কাছে সকলের মুরিদ হয়ে ইহকাল ও পরকালকে সুনিশ্চিত করা একান্ত আবশ্যক; অন্যথায় অভিশপ্ত শয়তানের সাথে হাশর-নাশরের সম্মুখিন হতে হবে এটা সুনিশ্চিত।
পরিশেষে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, ইসলাম ধর্মে প্রত্যেকের এল্মে শরীয়ত এবং এল্মে তাছওয়াফের শিক্ষার পরিপূর্ণতার জন্য একজন কামেলে মোকাম্মেল পীরের অনুসন্ধান করতে হবে এবং অতঃপর তাঁর কাছে শীষ্যত্ব গ্রহণ করে পরিপূর্ণ ঈমানদার হতে হবে, তবে প্রত্যেকের মানব জীবন সুন্দর ও সার্থক হবে। এভাবে মুমিন হতে হবে এবং প্রত্যেককে খাঁটি ভাবে ইবাদত-বন্দেগী করার স্তরে উপনীত হতে হবে।