পীর ফারসী ভাষার শব্দ। কুরআন শরীফে এ শব্দের প্রতিশব্দ হলো অলি, মুর্শিদ, ওসিলা, হাদী, আউলিয়া, সাদিক ইত্যাদি। হাদিস শরীফে এসেছে, “আলেমগণ নবী (আঃ) গণের উত্তরাধিকারী”। (আবু দাউদ, তিরমিজি)। হযরত মোজাদ্দেদ আলফেসানি (রঃ) ২৬৮ মকতুবে লিখেছেন, “পয়গম্বর (আঃ) গণের যে এল্ম অবশিষ্ট আছে তা দুই প্রকারঃ এল্মে আহকাম বা শরীয়তের আদেশ-নিষেধের জ্ঞান এবং এল্মে আছ্রার বা গুপ্ত রহস্যের জ্ঞান। ঐ আলেম ব্যক্তিই পয়গম্বর (আঃ) গণের উত্তরাধিকারী, যিনি ঐ দুই প্রকার এল্মের অংশ প্রাপ্ত হন। যিনি এক প্রকার অংশ প্রাপ্ত হন আর অপর অংশের প্রাপ্ত হননা, তিনি ওয়ারিশ নন”। এ আলেমই হলো হক্কানী আলেম যাকে পীর, মুর্শিদ, ওসিলা, সাদিক ইত্যাদি বলা হয়। হাদিস শরীফে এসেছে, “শুধু হক্কানী আলেমগনণই হলেন নবী (আঃ) গণের ওয়ারিশ”। (বুখারি, ইবনে মাজাহ, আহমদ ইবনে হাম্বল, তিরমিজি)
মোজাদ্দেদ আলফেসানি (রঃ) ২৬৮ মকতুবে আরো লিখেছেন, “হযরত নবীয়ে করিম (সাঃ) বলেছেন, আমার উম্মতের মধ্যে আলেমগণ বনী ইসরাইলের নবীগণ তুল্য। সর্ববিষয়ে সর্বোতভাবে আলেম ঐ ব্যক্তি যিনি ওয়ারিশ এবং উল্লিখিত উভয় প্রকার এল্মের পূর্ণ অংশধারী”।
নক্শবন্দি মোজাদ্দেদিয়া তরিকতের ঈমাম মোজাদ্দেদ আলফেসানি (রঃ) ৬১ মকতুবে লিখেছেন, “পীরের সংসর্গের উপরই এ তরিকার সম্পূর্ণ নির্ভরতা। কামেলে মোকাম্মেল পীরের অনুসন্ধানে যথাসাধ্য চেষ্টা করতে হবে। যদি নসিব গুণে এরূপ পীর পাওয়া যায় তখন তাঁর হাতে আত্মসমর্পণ করে তাঁরই ইচ্ছা ও আকাঙ্খা অনুযায়ী মুরিদ (অভিলাষী অর্থাৎ যে ব্যক্তি নিজ ইচ্ছায় আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের সংকল্প করে) স্বীয় আকাঙ্খা ও স্পৃহাকে পরিচালিত করবে এবং যেরূপ মৃত লাশ ধৌতকারীর হাতে থাকে তদ্রুপ নিজের অভিপ্রায়কে উক্ত বুজুর্গের ইচ্ছার উপর ন্যস্ত করবে”। এই প্রথম ফানাকে ফানাফিশ শায়খ বলে। এই ফানাই ভবিষ্যতে মুরিদের জন্য ফানাফির রাসুল (সাঃ) ও ফানাফিল্লাহর ওসিলা হবে।
মোজাদ্দেদ আলফেসানি (রঃ) ২৯২ মকতুবে লিখেছেন, “কামেলে মোকাম্মেল পীর ছাড়া কামালতী হাসিল করা (সিদ্ধিলাভ করা) কম্মিন কালেও কারো সাধ্য নেই। মুরিদকে এমন পীরের মধ্যস্থতা অন্বেষণ করতে হবে যিনি জজ্বা (আল্লাহর প্রতি আত্মীক আকর্ষণ) ও ছুলুক (আত্মিক ভ্রমন) উভয়বিধ সৌভাগ্য লাভ করেছেন ও পূর্ণ ফানা-বাকার অধিকারী হয়েছেন এবং ছায়ের-এল্লাল্লাহ (আল্লাহতায়ালার দিকে ভ্রমন), ছায়ের ফিল্লাহ্ (আল্লাহতায়ালার গুণাবলীর মধ্যে ভ্রমন), ছায়ের আনিল্লাহ বিল্লাহ্ (আল্লাহতায়ালার নৈকট্য হতে তাঁকে নিয়ে প্রত্যাবর্তন) ও ছায়ের ফিল আশ্ইয়া বিল্লাহ (আল্লাহতায়ালাকে নিয়ে সৃষ্ট বস্তু সমূহের মধ্যে ভ্রমন)- এ ছায়ের চতুষ্টয় পূর্ণ রূপে সমাপ্ত করেছেন”।
যদি পীর মজ্জুবে ছালেক হন এবং মুরিদগণ পীরের নিকট শিক্ষাপ্রাপ্ত হয়ে থাকে তবে তাকে স্পর্শমণিতুল্য বুঝতে হবে এবং তাঁর কথা ঔষধ এবং তাঁর নজর (দৃষ্টি) শাফা (মুক্তিদায়ক) অর্থাৎ এরূপ কামেল ব্যক্তির কথা ও দৃষ্টিতে ক্বলবের (অন্তর বা দিল) ব্যারাম দূরিভূত হয় এবং তাঁর তাওয়াজ্জোহ মৃত দিলকে জিন্দা করে এবং নিরস দিলকে সরস বা রওশন করে।
কামেলে মোকাম্মেল বা মুর্শিদে কামেলের সকল আলামত লেখে প্রকাশ করা অসম্ভব। যাঁকে দেখলে খোদার কথা স্মরণ হয়, হৃদয়ে শান্তি আসে, পাপের বাসনা চলে যায়, কৃত পাপের জন্য ভয় ও আক্ষেপ হয়, যাঁর মুরিদান প্রত্যেকে দোয়া দরূদ ও নামাযের সময় আল্লাহর ভয়ে ও মহব্বতে কেঁদে থাকে, যাঁর মুরিদানের ক্বলব ও সর্বাঙ্গে আল্লাহ আল্লাহ জিকির জারি হয়, যাঁর মুরিদানের প্রত্যেকে রাসুলেপাক (সাঃ)-এর মহব্বতে বিভোর থাকে, যাঁর মুরিদানের ফয়েজ ও জজ্বা হয়, যাঁর মুরিদান স্বপ্নযোগে আওলিয়া (রঃ) গণ ও পয়গম্বর (আঃ) গণকে অথবা মক্কা-মদিনা প্রভৃতি পবিত্র স্থান দেখতে পান তিনিই কামেল। সর্বোপরি নক্শবন্দি মোজাদ্দেদিয়া তরিকার পীর সেই ব্যাক্তি যিনি নক্শবন্দিয়া ও মোজাদ্দেদিয়া তরিকার সকল মোকামাত হাসিল করেছেন এবং তাঁর দ্বারা অপূর্ণ ব্যক্তিগণ পূর্ণত্ব লাভ করে ফানা-বাকা পর্যন্ত উপনীত হতে পারে।
নক্শবন্দি মোজাদ্দেদিয়া তরিকায় যিনি পীর হবেন তাঁকে প্রাথমিক পর্যায়ে মোরাদ বলে। মোরাদ অর্থাৎ আল্লাহপাক যাঁকে স্বীয় সান্নিধ্য প্রদানের ইচ্ছা করেন। হযরত মোজাদ্দেদ (রঃ) এর ২৯২ নং মকতুবে লিখিত আছে, “যারা মোরাদ বা অভীষ্ঠ হন তবে তাঁদের জন্যই সুসংবাদ। যেহেতু আল্লাহপাক তাঁদের আকর্ষণ ও মহব্বত এর পথ দ্বারা অতি উচ্চ মতলবে আকর্ষিত করে উপনীত করে থাকেন এবং যখন যে আদব-সম্মান শিক্ষা প্রদানের আবশ্যক হয়, তা কারো মাধ্যমে অথবা বিনা মাধ্যমে আল্লাহপাক তাদেরকে শিক্ষা প্রদান করেন। তাঁদের দ্বারা হঠাৎ যদি কোন ভুল-ভ্রান্তি হয়, তা অবিলম্বে তাঁদেরকে হুশিয়ার করে দেন এবং তাঁর জন্য কোন প্রকার তিরস্কার ও ভর্ৎসনা করেন না। যদি তাঁদের জন্য জাহেরী পথপ্রদর্শক পীরের আবশ্যক করে, তবে তাঁদের বিনা চেষ্টায় উক্ত পীরের প্রতি আল্লাহপাক নির্দেশ প্রদান করে থাকেন। মূল কথা, আল্লাহতায়ালার অনুগ্রহ তাঁদের সহায় থাকে ও তাঁদের জিম্মাদার হয়। কারো মাধ্যমে হোক অথবা বিনা মাধ্যমে হোক, তিনিই ইনাদের যাবতীয় কার্যের জন্য যথেষ্ট হয়ে থাকেন। “আল্লাহপাক যাকে ইচ্ছা করেন নির্বাচিত করে নেন। (কুরআন)”। সূরা বাকারার ৯০ আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন,
عَلىٰ مَن يَشاءُ مِن عِبادِهِ فَباءو بِغَضَبٍ ُ
অর্থ: আল্লাহ তার দাসদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা অনুগ্রহ করেন।
সূরা বাকারার ২৪৭ আয়াতে আল্লাহ বলেন,
العِلمِ وَالجِسمِ وَاللَّهُ يُؤتى مُلكَهُ مَن يَشاءُ وَاللَّهُ وٰسِعٌ عَليمٌ ُ
অর্থ: অবশ্যই আল্লাহ যাকে ইচ্ছা তার কর্তৃত্ব দান করেন।
সূরা কাহাফ এ ২৮ নং আয়াতে আল্লাহ বলেছেন,
وَلا تُطِع مَن أَغفَلنا قَلبَهُ عَن ذِكرِنا ُ
অর্থ: ঐ সকল লোকের তাবেদারী করো না বা হুকুম মেনো না যাদের ক্বলবকে আমি আমার জিকির হতে গাফেল করেছি।
অর্থাৎ যার ক্বলবে জিকির নেই, সে আল্লাহর নয়, আল্লাহর সাথে তার ন্যূনতম সর্ম্পকও নেই, সে মুর্শিদও নয়, সে কারো ক্বলবে জিকিরও জারি করতে পারেনা; তাই এরূপ লোকের সাথে কোন সংসর্গ রাখা যাবেনা, হুকুম মানা যাবেনা, তাবেদারীও করা যাবেনা। এরূপ লোককে আল্লাহ চিনেনও না আর তার কামেলে মোকাম্মেল মুর্শিদ বা পীর হওয়া তো অনেক দূরের কথা।
নক্শবন্দি মোজাদ্দেদিয়া তরিকার যিনি মুর্শিদে কামেল তিনি তাওয়াজ্জোহ প্রদানে প্রবল শক্তি সম্পন্ন এবং যিনি এক মুহুর্তও আল্লাহকে ভুলে থাকেন না। এই কামেলে মোকাম্মেল আউলিয়ার সহবতে মুরিদের জজ্বা হয় অর্থাৎ আল্লাহর দিকে ক্বলবের প্রবল আকর্ষণ সৃষ্টি হয় এবং ইনাদের প্রবল তাছিরে আবিষ্ট হয়ে কদম মুবারকে উপস্থিত থেকে খেদমত করতে মুরিদেরা তন্ময় হয়ে থাকে।
অলি-আল্লাহ সম্পূর্ণভাবে বোঝার বিষয় অন্তর বা ক্বলব দিয়ে, যা লেখে বর্ণনা করা প্রায় অসম্ভব। যার বাতেনী চক্ষু যত পরিস্কার হয়েছে সে তত পরিস্কার ভাবে বুঝবে অলি-আল্লাহকে। অন্ধের সামনে অমূল্য রত্নলঙ্কার শোভিত ভুবন বিদিত সুন্দরী থাকলেও সে তা বুঝবে না। এক এক জন অলি অনন্ত মারেফত সাগরে সন্তরণ করে যে মণিমুক্তা রতœ আহরণ করেন, জগৎ-এর সর্বশ্রেষ্ঠ দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক যদি তার বিন্দুমাত্র আভাস বুঝতে পারতো, তবে দর্শন-বিজ্ঞানকে পদাঘাত করে ঐ রতœ আহরণের জন্য প্রাণ উৎসর্গ করতো। পবিত্র ইসলাম ধর্ম গুপ্ত তত্তে¡র ভান্ডার, অলি-আল্লাহ (রঃ) গণ বহু সাধ্য-সাধনা দ্বারা যে সব তত্ত¡ আবিস্কার করেন পার্থিব সম্পদ আকাংঙ্খী ব্যাক্তিগণ যদি তা বুঝতে পারত, তবে সংসারকে বিসর্জন দিয়ে ঐ তত্তে¡র জন্য মুর্শিদে কামেলের পদধুলিতে লুটিয়ে পড়তো। ইসলামের নিগুঢ় রত্নভান্ডার এবং তত্ত¡ বলা বা দেখাবার নিয়ম নয়। বাহ্যিক রসনা এর স্বাদ গ্রহণ করতে অক্ষম, এগুলো ধ্যানযোগে দেখা ও হৃদয় দিয়ে স্বাদ গ্রহণের যোগ্য। এই সুধা পান করতে সহী সিলসিলার ওসিলার (সিদ্ধ গুরু) আবশ্যক। বিনা ওসিলায় সহস্র বছর কঠোর সাধনা করলেও এসব হাসিল করা যায় না।
ঈমান গাজ্জালী (রঃ) “কিমিয়া ছাদাত” কিতাবে লিখেছেন, “তামাম জাহানের ইবাদত একজন অলির ইবাদতের ছায়া মাত্র। কোন ব্যক্তি বেল্লফরজ (ফরজের সাথে) পঞ্চাশ হাজার বছর ইবাদত করলে একজন অলির ইবাদতের আদনা দরজায় পৌঁছিতে পারবে”।
তিনি আরো লিখেছেন, “জাহেদ সমস্ত রাত্রি ইবাদত বন্দেগী করে মাত্র একদিনের রাস্তা অতিক্রম করে আর আরেফ এক নিঃশ্বাসেই খোদাতায়ালার হুজুরিতে যেয়ে পৌঁছে”।
অলি-আল্লাহদের সঙ্গলাভে ও তাদের খেদমতের দ্বারা আল্লাহর পথে কি উন্নতি সাধিত হয়, তা হযরত মওলানা জালালুদ্দিন রুমী (রঃ) তাঁর মসনবী শরীফে লিখেছেন “এক মূহুর্ত অলি-আল্লাহর সংসর্গে বাস করা একশ বছরের বেরিয়া (অকপট) বন্দেগীর অপেক্ষাও উত্তম।” তিনি আরো লিখেছেন, “তুমি যদি আল্লাহর সংসর্গে বসতে চাও তবে আউলিয়ার সংসর্গে বস”।
হযরত আবুল হাসান গজনবী (রঃ) বলেছেন, “আউলিয়াগণ আল্লাহর অলি বা বন্ধু। তাঁদের কদম মুবারকের বরকতে দেশেতে বৃষ্টি হয়, জমিতে শস্য জন্মে। তাঁরা উম্মতে মুহাম্মদীর প্রদীপতুল্য। তাঁদের শত্রু বেআদব, মরদুদ ও দোজখী। তাঁদের প্রিয় ব্যক্তিরা হকশেনাছ ও বেহেশতী। তাঁদের জিকিরের সময় রহমত নাযিল হয়। তাঁদের মৃত্যুতে আসমান, যমীন এবং তার মধ্যস্থ সকল বস্তু ক্রন্দন করে। মোনাফেক এবং আল্লাহতায়ালার শক্রদের বড় আনন্দ হয়”।
যারা অলি-আল্লাহকে কষ্ট দেয় তারা উপযুক্ত শাস্তি পায়। বেঈমান হয়ে মারা যায়, কবরে কুকুরের চেহারা ধারণ করে। রাসুল (সাঃ)-এর খাতিরে তাঁর উম্মতের জাহেরী সুরৎ বা চেহারা পরিবর্তন হয় না, কিন্তু বাতেনীতে কুকুর খচ্চর ইত্যাদির আকার ধারণ করে। মহান আল্লাহ যাকে বাতেনী চক্ষু দান করেছেন তিনি তা বুঝতে পারেন।
পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ বলেন,
أَلا إِنَّ أَولِياءَ اللَّهِ لا خَوفٌ عَلَيهِم وَلا هُم يَحزَنونَ ُ
অর্থ: শুনে নাও! নিশ্চয় আল্লাহর অলিগণের কোন ভয় নেই এবং কোন জায়গায় তারা চিন্তিতও হবেন না। (সূরা ইউনুস, আয়াত-৬২)
হযরত মওলানা শাহ সুফী সৈয়দ ওয়াজেদ আলী (রঃ) হতে বর্ণিত আছে, “রাসুল (সাঃ) বলেছেন, আল্লাহতায়ালা জানিয়েছেন, যে আমার অলির সাথে- কি অলি মুমিনের সাথে দুশমনি রাখে ও ঘৃণা করে এবং যে তাঁকে দুঃখ দেয় বা অপমান করে, প্রকৃতপক্ষে সেই দুশমন তাঁর সাথে লড়াই করার জন্য আমাকে ডাকে। আল্লাহ বলেন, আমার সঙ্গে কি কেউ পারে”? হযরত ঈমাম আহমেদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন যে, “আল্লাহ আপন অলির শত্রুদরে শাস্তি নিজেই দেন। নিজেই সে শত্রুকে দুনিয়াতে আজাব করেন এবং আখেরাতেও আজাব করবেন”।