পরম করুণাময় মহান আল্লাহ সমগ্র বিশ্বজগৎ সৃষ্টি করেছেন। তিনি অপ্রয়োজনে ও অকারণে কিছুই সৃষ্টি করেননি। মানব জাতিকে সমগ্র সৃষ্টির মধ্যে থেকে নির্বাচিত করে নির্দিষ্ট দায়িত্ব ও কর্তব্য সহকারে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। মহান আল্লাহ সকল সৃষ্টির স্রষ্টা, তাই সৃষ্ট জীবের জন্য জীবন বিধান দেবার মালিকও তিনি।
মহান আল্লাহ এ মহাসৃষ্টির উদ্দেশ্য ব্যক্ত করতে যেয়ে ঘোষণা করেছেন,
كنت كنزا مخفيا فاردت ان اعرف فخلقت الخلقُُ
অর্থ: আমি গুপ্তধন সদৃশ ছিলাম, আমার প্রেম সাগরে জোয়ার এলো। আমি চাইলাম আমি পরিচিত হই; অতঃপর পরিচিত হবার মানসে আমি সমস্ত সৃষ্টিজগৎ সৃষ্টি করি। (মকতুবাত শরীফ)
হাদিসে কুদসীতে এসেছে-
كنت كنزا مخفيا فاحببت ان اعرف فخلقت الخلق لاعرب ُ
অর্থ: আমি এক গুপ্ত ভান্ডার ছিলাম। অতঃপর আমি পরিচিত হবার জন্য বিশ্বচরাচর সৃষ্টি করলাম। (সিররুল আসরার, হযরত আব্দুল কাদের জিলানী রঃ)
এ দ্বারা বোঝা যায়, আল্লাহ স্রষ্টা হিসেবে স্বীয় পরিচিতির জন্যই সমগ্র বিশ্বভূবনকে সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ “আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টির সেরা” হিসেবে মানুষকে সৃষ্টি করেছেন এবং তাদের সেবার জন্য দুনিয়ার সমস্ত কিছু সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টির সেরা হিসেবে মানুষের উপরই ইহজগতে আল্লাহর খেলাফতি বা প্রতিনিধিত্বের দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে, যাতে মানুষ শরীয়ত, তরিকত, হকিকত ও মারেফতের সমন্বয়ে আল্লাহর দয়ার দান দ্বীন ইসলামের নির্দেশিত পথে অবগাহন করে সৃষ্টিকর্তার পরিচিত হবার জ্ঞানে জ্ঞানী হয়ে মানব জীবনকে ধন্য করতে পারে।
মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেছেন,
إِنَّ ٱلدِّينَ عِندَ ٱللَّهِ ٱلْإِسْلَٰم ُ
অর্থ: নিশ্চয় আল্লাহতায়ালার নিকট ইসলামই একমাত্র মনোনীত জীবন ব্যবস্থা। (সূরা আল-ইমরান, আয়াত-১৯)
সমস্ত সৃষ্টিই যখন মহান আল্লাহর পরিচয় লাভের উদ্দেশ্যে সৃষ্ট, তখন তাদের সকলেরও ফিতরাতী বা স্বভাবগত ধর্মই হলো ইসলাম। তবে মানুষ ও জ্বিন জাতি ছাড়া সমস্ত সৃষ্টি বাধ্যতামূলক ভাবে ইসলামের উপর পরিচালিত। যেমনঃ আম গাছের কোন অধিকার এবং ক্ষমতা নেই কাঁঠাল জন্মাবার, কাঠাঁল গাছের আম, বেল গাছের মেওয়া, মেওয়া গাছের বেল ইত্যাদি। কিন্তু মানুষ ও জ্বিন জাতিকে নিজ বিবেক অনুযায়ী স্বেচ্ছাধীন কার্যকলাপের পূর্ণ অধিকার দেওয়া হয়েছে। আর এ স্বাধীন অধিকারের বলেই ফুটে উঠেছে মানুষের খেলাফতির স্বার্থকতা। এ খেলাফতির বাস্তব রূপ হলো শরীয়ত বা কুরআন-হাদিস এবং বাস্তব মানুষ হলেন নবী-রাসুল (আঃ) গণ ও অলি-আল্লাহ (রঃ) গণ।
ঈমাম গাজ্জালী (রঃ) তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ “কিমিয়া সাদাতে” লিখেছেন, “তোমরা একথা জেনে রাখ এবং মনের মধ্যে সঠিক বিশ্বাস রাখ যে আত্মজ্ঞানই তত্ত¡জ্ঞানের (আল্লাহকে চেনার জ্ঞান) চাবিকাঠি”। অর্থাৎ যিনি নিজেকে চিনেছেন, তিনি আল্লাহকে জেনেছেন। নিজেকে চেনা মানে নিজের আত্মার পরিচয় জানা। আর আত্মার বা ক্বলবের মাধ্যমে আল্লাহর পরিচয়, জ্ঞান ও মারেফত অর্জন সম্ভব। যে আত্মা আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছুতে আসক্ত, সেই আত্মা কখনোই আল্লাহর মারেফত অর্জনে সক্ষম হয়না। পরকালে আত্মারই অনুসন্ধান হবে, আত্মাই জিজ্ঞাসিত ও তিরস্কৃত হবে (সূরা বাকারা, আয়াত-২৮১)। আত্মা বা ক্বলব আল্লাহর পরিচয়ের জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে পবিত্র ও নির্মল হলে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করে সে সৌভাগ্যশালী হবে। প্রকৃতপক্ষে, আত্মা মহান আল্লাহর অনুগত হলে ইবাদতের সময় তার সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বা আত্মাকে পবিত্র করার নিয়ম-নীতি যে এল্মের দ্বারা জানা যায় তাকে এল্মে আছরার বা এল্মে তাছওয়াফ বা মারেফত বলে। মূলত অন্তর বা আত্মা বা ক্বলবের আলো বা অন্ধকারের কারণে বাহ্যিক ভাবে একজনের সৎ গুণাবলী ও দোষাবলী প্রকাশিত হয়।
রাসুলেপাক (সাঃ) ইরশাদ করেছেন,
الا ان فى الجسد لمضغة اذا صلحت صلح الجسد كله واذا فسدت فسد الجسد كله ، الا وهى القلب ُ
অর্থ: সাবধান! শরীরের মধ্যে এক টুকরো মাংসপিন্ড রয়েছে, যদি সেটা সংশোধিত হয়, তবে সমস্ত শরীরই সংশোধিত হয়। আর যদি তা খারাপ হয়, তবে সমস্ত শরীরই খারাপ হয়। (বুখারি, মকতুবাত শরীফ)
মহানবী (সাঃ) দ্ব্যর্থহীনভাবে ইরশাদ করেছেন,
শরীরে এক টুকরা মাংস আছে যা পরিশুদ্ধ হলে শরীর পরিশুদ্ধ হয়, আর তা নাপাক হলে শরীর নাপাক হয়। যা পরিষ্কারের ঔষধ হলো আল্লাহর জিকির আর জিকির দায়েমী করার জন্য প্রয়োজন কামেল মুর্শিদ। (বুখারি, মুসলিম)
মহান আল্লাহ বলেছেন,
قَدْ أَفْلَحَ مَن زَكَّىٰهَا ُ وَقَدْ خَابَ مَن دَسَّىٰهَا ُ
অর্থ: যে অন্তরকে পবিত্র করেছে, সে মুক্তি পেয়েছে। এবং যে অন্তরকে কলুষিত করেছে, সে ধ্বংস হয়েছে। (সূরা আশ-শামস, আয়াত-৯,১০)
ক্বলব বা আত্মা বা অন্তর পরিশুদ্ধিকরণের দায়িত্ব মহান আল্লাহ দিয়েছেন নবী-রাসুল (আঃ) গণকে এবং তাঁদের অনুপস্থিতিতে অলি-আল্লাহ বা কামেলে মোকাম্মেল আউলিয়া (রঃ) গণকে। নবী-রাসুল (আঃ) গণ এবং কামেল মুর্শিদ (রঃ) গণই আত্মার পরিশুদ্ধির নিগুঢ় রহস্যময় জ্ঞানের অধিকারী, আর এ নিগুঢ় তত্ত¡জ্ঞানকে বেলায়েত বা এল্মে তাছওয়াফ বা মারেফত বা এল্মে বাতেন বলে।
এল্মে বাতেন এমন এক ধরনের আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞান, যা কারো নিকট পড়া ব্যতিরেকে মহান আল্লাহ কুদরতি ভাবে যাকে ইচ্ছা করেন তাকে দান করেন। মাতৃগর্ভ থেকেই এ জ্ঞান নবী-রাসুল (আঃ) গণ আল্লাহ কর্তৃক প্রদত্ত হতেন। এই এল্মে বাতেনকে এল্মে লাদুন্নীও বলা হয়। এ এমন এক ধরনের এল্মে ইয়াক্বীন (নিশ্চিত জ্ঞান), যা দ্বারা কোন বিষয়ের ভবিষ্যৎ কি হবে পূর্বেই বলে দেয়া সম্ভব।
পবিত্র কুরআনে সূরা কাহাফের ৭১-৮২ আয়াতে হযরত মুসা (আঃ) ও হযরত খিজির (আঃ)-এর ঘটনায় দেখতে পাওয়া যায়, হযরত মুসা (আঃ) আকায়েদ ও আমলে পরিপূর্ণ থাকা সত্তে¡ও মহান আল্লাহ তাঁকে হযরত খিজির (আঃ)-এর নিকট বাতেনী এল্ম অবগত হবার জন্য প্রেরণ করেছিলেন।
মহান আল্লাহ বলেছেন,
وَعَلَّمْنَٰهُ مِن لَّدُنَّا عِلْمًا ُ
অর্থ: তাঁকে (খিজির) আমি এক আপন “এল্মে লাদুন্নী” (বাতেনী এল্ম) শিখিয়েছিলাম। (সূরা কাহাফ, আয়াত-৬৫)। এ এল্মকেই বুজুর্গগণ বেলায়েত বা এল্মে তাছওয়াফ বা মারেফত বলে অভিহিত করে থাকেন।
হাদিস শরীফে হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত আছে-
اِنَّ مِنَ الْعِلْمِ كَهَيْنَةِ الْمَكْنُوْنِ لَا يَعْلَمُهُ اِلَّا الْعُلَمَاءُ بِاللهُِ
অর্থ: নিশ্চয় এল্মের মধ্যে এক প্রকার গুপ্ত এল্ম আছে, ঐ এল্ম আলেম বিল্লাহ (যে আলেম খোদাকে চিনে অর্থাৎ মুর্শিদে কামেল) ছাড়া আর কেহ অবগত নয়। (আওয়ারেফ)।
عَنْ اَبِىْ هُرَيْرَةَ، قَالَ حَفِظْتُ مِنْ رَسُوْلِ اللهِ صَلى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وِعَاءَيْنِ، فَاَمَّا أَحَدُهُمَا فَبَثَثْتُهُ، وَاَمَّا الآخَرُ فَلَوْ بَثَثْتُهُ قُطِعَ هٰذَا الْبُلْعُوْمُُ
অর্থ: হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, আমি হুজুর (সাঃ) হতে দু’প্রকার এল্ম অর্জন করেছি। একটি তোমাদের নিকট প্রকাশ করেছি (এল্মে জাহের), অপরটি যদি প্রকাশ করি তবে আমার গলা কাটা যাবে। (বুখারি, কিতাবুল ইল্ম, বাবু হিফজিল ইল্ম)
যে জ্ঞান আবু হুরায়রা (রাঃ) প্রকাশ করেছেন সেটি শরীয়ত আর যেটি প্রকাশ করেননি সেটি এল্মে বাতেন বা মারেফত। এটি সাংঘাতিক বিপদজনক জ্ঞান যা সবাই সহ্য করতে পারেনা। মারেফত প্রকাশ ও প্রচারের জন্য হযরত মনসুর হাল্লাজ (রঃ) কে শূলে জীবন উৎসর্গ করতে হয়েছে। মারেফত প্রচারের জন্য হযরত বায়েজিদ বোস্তামী (রঃ) কে সাতবার বোস্তাম শহর থেকে বিতাড়িত হতে হয়েছে।
হযরত মওলানা কেরামত আলী (রঃ) আওয়ারেফ হতে “জাত্তোকওয়া” নামক কিতাবের ৬২ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, “এল্ম আল্লাহতায়ালার আছরার (গুঢ় রহস্য) ও পুষিদাভেদ (গুপ্ত তত্ত¡), অলি-আল্লাহ সকল যার আমানতদার। আল্লাহর পরিচয়ের গুঢ় রহস্যময় গুপ্ত তত্ত¡জ্ঞান বড় বড় দরবেশদের সর্দারদের নিকট বিনা শ্রবণে ও বিনা ছবকে প্রাপ্ত হওয়া যায় অর্থাৎ তাঁদের খেদমত করলে তাওয়াজ্জোহতে তা ছিনা থেকে ছিনা হাসিল হতে থাকে”।
মহান আল্লাহ বলেছেন,
وَأَسْبَغَ عَلَيْكُمْ نِعَمَهُۥ ظَٰهِرَةً وَبَاطِنَةً ُ
অর্থ: এবং খোদাতায়ালা তোমাদের উপর আপন জাহেরী ও বাতেনী নেয়ামত (অনুগ্রহ বা দান) পূর্ণ করেছেন। (সূরা লোকমান, আয়াত-২০)
জাহেরী দান চর্মচক্ষে দেখা যায় এবং বাতেনী দান চর্মচক্ষে দেখা যায় না। ইসলাম ও কুরআন হলো জাহেরী দান আর ইরফান বা খোদা পরিচিতি হলো বাতেনী দান। অর্থাৎ শরীয়তের আদেশ-নিষেধ হলো জাহেরী দান আর তরিকত বা ক্বলবের দ্বারা আল্লাহর হুজুরী অর্জনের পথ হলো বাতেনী দান। গভীর ভাবে বললে, হুজুরেপাক (সাঃ)-এর অনুসরণ হলো এল্মে জাহের আর তাঁর (সাঃ) প্রতি ভালোবাসা হলো এল্মে বাতেন। আরো গভীর ভাবে বললে, শরীয়ত হলো রাসুলপাক (সাঃ)-এর দেহ মুবারকের অবস্থানাদির নাম আর তরিকত হচ্ছে হুজুরপাক (সাঃ)-এর ক্বলব মুবারকের অবস্থানাদির রহস্যময় জ্ঞান।
মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেছেন,
أَفَمَن شَرَحَ ٱللَّهُ صَدْرَهُۥ لِلْإِسْلَٰمِ فَهُوَ عَلَىٰ نُورٍ مِّن رَّبِّهِ ُ
অর্থ: আল্লাহ যার ক্বলব ইসলামের জন্য উন্মুক্ত করেছেন অতঃপর সে আপন প্রতিপালকের নূরের উপরে আছেন।” (সূরা আয যুমার, আয়াত-২২)
অর্থাৎ হেদায়েতের নূর অন্য সব ধরনের নূর থেকে আলাদা। এ নূর বা জ্যোতিই কালেমা বা কুরআন পাবার উপায়। হযরত শেখ শিবলী (রঃ) বলেছেন, খোদাতায়ালা তাদের হৃদয় প্রসার করেছেন, এতে করে তাদের হৃদয় বা ক্বলব রওশন (আলোকিত) হয়েছে। তারা নফছ পবিত্র করে কামেল, অলি ও সিদ্দিক হয়েছেন অর্থাৎ প্রত্যেক দমে দমে আল্লাহকে স্মরণ করার নিয়ামত হাসিল করেছেন। এ রকম আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন থাকা ও আল্লাহর মহব্বতে ডুবে থাকা আউলিয়া ও সিদ্দিকের ব্যবসায়।
আল্লাহ প্রদত্ত সুসংবাদ কামালতে নবুয়ত প্রাপ্তির মাধ্যমে একজন নবী-রাসুল (আঃ) হয়েছেন। কিন্তু রাসুল (সাঃ) শেষ নবী হওয়ায় নবুয়তের পথ রুদ্ধ হয়ে যায় আনুষ্ঠানিকভাবে। এজন্য রাসুলেপাক (সাঃ)-এর যারা প্রতিনিধিত্ব করবেন বা নায়েবে নবী হবেন তারা ছিলেন প্রথমত চারজন খলিফা (রাঃ)। চারজন খলিফাই (রাঃ) ছিলেন কামালতে কাইয়ুমুনিয়াত এর অধিকারী, যা কামালতে নবুয়ত হতে অপেক্ষাকৃত কম মর্যাদার। এরপরে এসেছেন অলি-আল্লাহ বা আউলিয়া (রঃ) গণ, যারা কামালতে বেলায়েত প্রাপ্ত হয়েছেন মহান আল্লাহর কৃপায়। কামালতে বেলায়েত এর মর্যাদা আবার কামালতে কাইয়ুমুনিয়াত থেকে অপেক্ষাকৃত আরো কম। কিন্তু দ্বি-সহ¯্রাব্দের মোজাদ্দেদ হযরত আহমদ সেরহিন্দি (রঃ) যিনি জগৎ এর শেষ তরিকা মোজাদ্দেদিয়া তরিকার ঈমাম, তিনি এবং তাঁর তিন আওলাদ ছিলেন কাইয়ুমুনিয়াত প্রাপ্ত কামেলে মোকাম্মেল আউলিয়া। শুধুমাত্র এ নক্শবন্দি মোজাদ্দেদিয়া তরিকার আউলিয়া (রঃ) গণই কামালতে নবুয়ত ও কামালতে বেলায়েতের মর্তবাধারী। হযরত মোজাদ্দেদ আলফেসানি (রঃ) নবুয়তের তাক হতে অসাধারণ গুপ্ত রহস্যের সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন, যা প্রকাশযোগ্য ছিলো কিন্তু মহান আল্লাহর আদেশে তা প্রকাশ করেননি। উচ্চ স্তরের ফেরেশতাবৃন্দ এই দৌলত বা সৌভাগ্যের শরীক বা অংশী। পয়গম্বর (আঃ) গণের অনুসরণকারীগণের মধ্যে যাকে ইচ্ছা আল্লাহপাক তা প্রদান করেছেন। এই গুপ্ত রহস্যের এল্ম আবু হুরায়রাও (রাঃ) প্রকাশ করেননি আল্লাহর আদেশে, যেভাবে প্রকাশ করেননি হযরত মোজাদ্দেদ আলফেসানি (রঃ)। এই গুপ্ত রহস্যের এল্ম সকলের জ্ঞানে সংকুলান হয় না, এ জন্য মহান আল্লাহ তা সবার কাছে প্রকাশ করতে নিষেধ করেছেন। “এটা আল্লাহতায়ালার অনুগ্রহের প্রাচুর্য, যাকে ইচ্ছা করেন তিনি তা প্রদান করেন, তিনি তো মহাঅনুগ্রহশীল। (কুরআন)”। (মকতুবাত নং- ২৬৭)
রাসুলেপাক (সাঃ) এল্মে নবুয়ত ও এল্মে বেলায়েতের মহাসমুদ্র ছিলেন। পবিত্র কালাম মজিদে রাসুল (সাঃ) কে সিরাজাম মুনিরা বা জ্যোতির্ময় নূরের প্রদীপ বলে অভিহিত করেছেন মহান আল্লাহ। এর তাৎপর্য এই যে, একটি প্রদীপ হতে লুমে লুমে লক্ষ লক্ষ প্রদীপ প্রজ্বলন করলেও যেন আসল প্রদীপের জ্যোতির্ময়তা রাসুলেপাক (সাঃ) হতে বেলায়েতের অপার্থিব ও ঐশ¦িরক নেয়ামত তাঁর উম্মতের অলি-আল্লাহগণ কেয়ামত পর্যন্ত একে অপর হতে হাসিল করতে থাকবেন। এতে ঐ এল্মের বিন্দুমাত্রও কমতি হবে না।
“মাজাহারে হক” কেতাবের বাবুল ঈমান অধ্যায়ে আছে, “ধর্মের ভিত্তি ও তার পূর্ণতা ফিকাহ, আকায়িদ ও তাছওয়াফের উপর নির্ভর করে”। ফিকাহ হচ্ছে ইসলামের যাবতীয় আদেশ-নিষেধ ও ক্রিয়া-কলাপের বর্ণনা; আকায়েদ হচ্ছে ধর্ম বিশ্বাস যা ঈমান আনার বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত এবং তাছওয়াফ শব্দটি দ্বারা আল্লাহতায়ালার প্রতি মনোনিবেশ করার ইঙ্গিত অর্থাৎ এল্মে বাতেন বা ক্বলবের মাধ্যমে আল্লাহকে হাসিল করার গুপ্ত বিদ্যা শিক্ষার প্রতি নির্দেশ করা হয়েছে যাকে এহ্সানও বলে। মেশকাত শরীফে হযরত ওমর ইবনে খাত্তাব (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত একটি হাদিসে জিবরাইল (আঃ) উক্ত তিন প্রকার এল্মের কথাই উল্লেখ করেছেন। হাদিসটি এইঃ হযরত ওমর ইবনে খাত্তাব (রাঃ) রেওয়ায়েত করেছেন যে, একদা আমরা রাসুলেপাক (সাঃ)-এর নিকটে উপস্থিত ছিলাম। এমন সময় অতিশয় সাদা কাপড় পরিহিত এবং অতি কালো কেশযুক্ত এক ব্যক্তি সেখানে এসে উপস্থিত হলো। তাঁর মধ্যে সফরের কোন চিহ্ন ছিলোনা এবং আমাদের মধ্যে কেউই তাকে চিনতে পারলো না। এমন কি তিনি রাসুলেপাক (সাঃ)-এর সামনাসামনি বসে দুই জানুর উপর দুই হাত রেখে হযরতকে একে একে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন। প্রথমে জিজ্ঞাসা করলেন, হে মুহাম্মদ (সাঃ), ইসলাম কি? হযরত (সাঃ) দয়া করে বললেন, “তুমি কালেমা শাহাদত পড়বে অর্থাৎ সাক্ষ্য দিবে যে আল্লাহ ছাড়া আর কেহ আমাদের মাবুদ (উপাস্য) নাই এবং মুহাম্মদ (সাঃ) তাঁর প্রেরিত নবী, তুমি নামায পড়বে, যাকাত দেবে, রমজানের রোযা রাখবে এবং রাস্তা খরচ জুটলে বায়তুল্লায় হজ করবে”। তিনি বললেন, সত্য বলেছেন। আমরা আশ্চার্যাম্বিত হলাম যে, তিনি নিজেই প্রশ্ন করছেন আবার নিজেই সত্যতা স্বীকার করছেন। দ্বিতীয়বার জিজ্ঞাসা করলেন, ঈমান কি বিষয়? রাসুল (সাঃ) দয়া করে উত্তর দিলেন যে, “তুমি বিশ্বাস স্থাপন করবে আল্লাহর উপর এবং তাঁর ফেরেশতা, আসমানি কিতাব, রাসুল ও কেয়ামতের উপর এবং তকদিরের ভালো-মন্দ আল্লাহর তরফ থেকে হচ্ছে এ কথার উপর; এর নাম ঈমান”। তিনি বললেন, সত্য বলেছেন। তিনি তৃতীয়বার হযরত (সাঃ) কে জিজ্ঞাসা করলেন, এহ্সান কি বিষয়? হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) দয়া করে বললেন যে, “আল্লাহতায়ালার বন্দেগী এইরূপ কর যেন তুমি তাকে দেখছো। যদি তুমি এ অবস্থায় না পারো তবে বিশ্বাস করবে যে তিনি নিশ্চয় তোমাকে দেখছেন। এর নাম এহ্সান”। এই এহ্সানই এল্মে বাতেন বা মারেফত বা তাছওয়াফ এর সাথে সম্পর্কিত। অর্থাৎ আল্লাহতায়ালার হুজুরীতে পুরা বিশ্বাস ও তাছদিক (সত্য জানা) হাসিল হওয়া এবং মাবুদের মোশাহেদা ও তাঁর জাতপাকের হুজুরীতে ডুবে যাওয়াই এল্মে তাছওয়াফ।
উপরের ব্যাপক আলোচনা হতে এটা পরিষ্কার যে, এল্মে তাছওয়াফ বা মারেফত বা বাতেন বা বেলায়েত সম্পূর্ণরূপে মানুষের ক্বলবের সাথে সম্পর্কিত। আর ক্বলবই হলো অদৃশ্য বিষয় দেখার চোখ। নক্শবন্দি মোজাদ্দেদিয়া তরিকায় একজন মুরিদ কামেলে মোকাম্মেল পীরের কাছে বায়আত গ্রহণ করলে তার মৃত ক্বলব জীবিত হয়ে আল্লাহর জিকির শুরু করে এবং তখন ঐ ক্বলবের মাধ্যমে অদৃশ্য বিষয়গুলো (আল্লাহ, ফেরেশতা, নবী-রাসুল, তকদীর, কেয়ামত, হাশর ইত্যাদি) দেখে সন্দেহমুক্ত ইয়াকীন বা দৃঢ় বিশ্বাস অর্জন নিশ্চিত হয়। এ ক্বলবের জাগ্রত করার শিক্ষা পৃথিবীর কোন জাহেরী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে অর্জন সম্ভব নয়। এ শিক্ষার কোন সময় বা বয়সও নেই। এ শিক্ষা বর্তমান জামানায় শুধুমাত্র আল্লাহ ও রাসুল (সাঃ) নির্ধারিত সর্বশেষ মোজাদ্দেদিয়া তরিকার একজন মুর্শিদে কামেলের নিকট থেকেই অর্জন করা সম্ভব।
কুরআন এবং হাদিস শরীফের অসংখ্য স্থানে তরিকা, তরিকত, হকিকত, মারেফত, ক্বলব, নূর ইত্যাদি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা এবং দিকনির্দেশনা আছে যার সব কিছুকেই এক কথায় এল্মে বেলায়েত বা এল্মে লাদুন্নী বা এল্মে তাছওয়াফ বলে। নিচে কিছু গুরুত্বপূর্ণ নমুনা তুলে ধরা হলো –
সূরা আল-ইমরান
لَقَدْ مَنَّ ٱللَّهُ عَلَى ٱلْمُؤْمِنِينَ إِذْ بَعَثَ فِيهِمْ رَسُولًا مِّنْ أَنفُسِهِمْ يَتْلُوا۟ عَلَيْهِمْ ءَايَٰتِهِۦ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ ٱلْكِتَٰبَ وَٱلْحِكْمَةَ وَإِن كَانُوا۟ مِن ُ
অর্থ: আল্লাহ তাদের নিজেদের মধ্য থেকে রাসুল পাঠিয়ে অবশ্যই বিশ্বাসীদের অনুগ্রহ করেছেন। সে তাঁর আয়াতগুলো তাঁদের কাছে তেলওয়াত করে, তাদেরকে (ক্বলবকে আত্মশুদ্ধির দ্বারা পবিত্র করা) পরিশুদ্ধ করে আর কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেয়, যদিও তারা পূর্বে হেদায়েত প্রাপ্ত ছিলোনা। (সূরা আল-ইমরান, আয়াত-১৬৪)
সূরা বাকারা
رَبَّنَا وَٱبْعَثْ فِيهِمْ رَسُولًا مِّنْهُمْ يَتْلُوا۟ عَلَيْهِمْ ءَايَٰتِكَ وَيُعَلِّمُهُمُ ٱلْكِتَٰبَ وَٱلْحِكْمَةَ وَيُزَكِّيهِمْ ُ
অর্থ: (ইব্রাহিম আঃ আল্লাহর কাছে দোয়া করেন) হে আমার প্রতিপালক! তাদের কাছে তাদের মধ্য থেকে এক রাসুল প্রেরণ করো যে তোমার আয়াত তাদের কাছে তেলওয়াত করবে, তাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেবে এবং তাদেরকে পবিত্র (ক্বলবের পরিশুদ্ধি) করবে। (সূরা বাকারা, আয়াত-১২৯)। একই সূরায় আল্লাহ বলেন,
كَمَآ أَرْسَلْنَا فِيكُمْ رَسُولًا مِّنكُمْ يَتْلُوا۟ عَلَيْكُمْ ءَايَٰتِنَا وَيُزَكِّيكُمْ وَيُعَلِّمُكُمُ ٱلْكِتَٰبَ وَٱلْحِكْمَةَ وَيُعَلِّمُكُم مَّا لَمْ تَكُونُوا۟ تَعْلَمُونَ ُ
অর্থ: আমি তোমাদেরই একজনকে রাসুল করে পাঠিয়েছি যে আমার আয়াতগুলো তোমাদের কাছে তেলওয়াত করে, তোমাদেরকে পবিত্র (ক্বলবের পরিশুদ্ধি) করে, তোমাদেরকে শিক্ষা দেয় কিতাব ও তত্ত¡জ্ঞান, আর শিক্ষা দেয় যা তোমরা জানতে না। (সূরা বাকারা, আয়াত-১৫১)
সূরা নূর
ٱللَّهُ نُورُ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلْأَرْضِ ُ
অর্থ: আল্লাহপাক হচ্ছেন আসমান ও যমীনের নূর বা জ্যোতি। (সূরা নূর, আয়াত-৩৫)। যে ক্বলব কামেলে মোকাম্মেল পীরের দ্বারা আত্মশুদ্ধি লাভ করেছে, সেই ক্বলব আল্লাহর নূরের সন্ধান লাভ করে। একই আয়াতে আল্লাহ বলেছেন,
ٱللَّهُ لِنُورِهِۦ مَن يَشَآءُ وَيَضْرِبُ ُ
অর্থ: আল্লাহ যাকে ইচ্ছা করেন তাকে সেই নূরের সন্ধান দেন। (সূরা নূর, আয়াত-৩৫)
সূরা বনী ইসরাইল
وَمَن كَانَ فِى هَٰذِهِۦٓ أَعْمَىٰ فَهُوَ فِى ٱلْءَاخِرَةِ أَعْمَىٰ وَأَضَلُّ سَبِيلً ُ
অর্থ: ইহজীবনে আল্লাহর নূর দেখার সৌভাগ্য যার (যে ক্বলবের) হবে না, পরকালেও সে অন্ধ এবং আরো বেশী পথভ্রষ্ট। (সূরা বনী ইসরাইল, আয়াত-৭২)
সূরা জুমআ
يُسَبِّحُ لِلَّهِ مَا فِى ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَمَا فِى ٱلْأَرْضِ ٱلْمَلِكِ ٱلْقُدُّوسِ ٱلْعَزِيزِ ٱلْحَكِيمِ ُ
অর্থ: আসমান ও যমীনে যা কিছু আছে সবই আল্লাহর প্রশংসা ও মহিমা ঘোষণা করে। (সূরা জুমআ, আয়াত-১)। যিনি কামেলে মোকাম্মেল আউলিয়া তিনি এ জিকির শুনতে পান ও দেখতে পান ক্বলবের কান ও চোখ দিয়ে।
সূরা আযযা-রিয়াত
وَفِىٓ أَنفُسِكُمْ أَفَلَا تُبْصِرُونَ ُ
অর্থ: সমস্ত সৃষ্টির মধ্যে যেরূপ আমার অস্তিত্ব বিদ্যমান, তেমনই তোমাদের প্রত্যেকের মধ্যে আমার নিদর্শন রয়েছে তোমরা কি তা দেখতে (ক্বলবের চোখ দিয়ে) পাও না? (সূরা আযযা-রিয়াত, আয়াত-২১)। আরশ ও ফরশ, জল ও স্থল, পাহাড় ও পর্বত, শয়তান, আল্লাহ ও তার রহমত, রাসুল (সাঃ) ও তার ক্বলবের রহস্য সবই মানুষের মধ্যে রয়েছে। এজন্যই হাদিস শরীফে এসেছে-
من عرف نفسه فقد عرف ربه ُ
অর্থ: যে নিজেকে চিনেছে সে তার রবকে চিনেছে। (আল্লামা ইবনে হাজার হায়তামী আল মক্কী এর গ্রন্থ “ফতোয়ায়ে হাদিসিয়্যাহ” এর পৃষ্ঠা-২১১)। সংক্ষেপে বলা যায়, আল্লাহর সাথে বান্দার পরিচয় ও সম্পর্ক স্থাপন অথবা তাঁর রেজামন্দি হাসিল করা একান্ত আবশ্যক। এটা বর্তমান জামানায় তরিকায়ে নক্শবন্দি মোজাদ্দেদিয়ার কামেল মুর্শিদের সংস্পর্শে এসে তারই দিকনির্দেশনায় কঠোর শ্রম ও সাধনার মাধ্যমে অর্জন করতে হবে। এভাবেই আল্লাহকে পাওয়া সম্ভব। আল্লাহকে পাবার জন্য ও তাঁর সৃষ্টি রহস্যের সত্য অনুসন্ধানের ইশারা আল্লাহ কুরআনের নিম্মোক্ত আয়াতে দিয়েছেন-
سَنُرِيهِمْ ءَايَٰتِنَا فِى ٱلْءَافَاقِ وَفِىٓ أَنفُسِهِمْ حَتَّىٰ يَتَبَيَّنَ لَهُمْ أَنَّهُ ٱلْحَقُّ أَوَلَمْ يَكْفِ بِرَبِّكَ ُ
অর্থ: আমি আমার নিজের চিহ্নসমূহ বিশ্বজগৎ ও মানুষের শরীরে প্রকাশ করেছি যাতে শেষ পর্যন্ত তাদের নিকট সুস্পষ্ট হয়, নিশ্চয় তা সত্য (রাসুলেপাক সাল্লালাহু আলাইহিস সালাম কর্তৃক পূর্বেই ঘোষিত এ সংক্রান্ত সংবাদ)। (সূরা হামীম সাজদা, আয়াত-৫৩)
এ সত্যানুসন্ধান একজন তার ক্বলবের আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে কঠোর সাধনা ও পরিশ্রমের দ্বারা অর্জন করতে পারে। পবিত্র কুরআনে দয়াময় আল্লাহ বলেছেন,
وَٱلَّذِينَ جَٰهَدُوا۟ فِينَا لَنَهْدِيَنَّهُمْ سُبُلَنَا وَإِنَّ ٱللَّهَ لَمَعَ ٱلْمُحْسِنِينَ ُ
অর্থ: এবং যারা আমার পথে পরিশ্রম করে নিশ্চয়ই আমি তাদেরকে আমার আপন পথ দেখাবো। (সূরা আনকাবুত, আয়াত-৬৯)। এ পথই আল্লাহর নিজস্ব বা খাস পথ যাকে তরিকতের রাস্তাও বলে। এ পথের ব্যাপারে কুরআনে আল্লাহ বলেছেন,
لِكُلٍّ جَعَلْنَا مِنكُمْ شِرْعَةً وَمِنْهَاجًا ُ
অর্থ: আমি তোমাদের প্রত্যেকের জন্য দুটি পথ দিয়েছি, একটি হলো শরীয়ত আর অন্যটি হলো খাস পথ (তরিকতের রাস্তা)। (সূরা মায়েদা, আয়াত-৪৮)
তরিকতের পথে যারা মেহনত করে নিজের ক্বলবকে আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে আল্লাহর সৃষ্টি রহস্যের জ্ঞান অর্জন করত: আল্লাহকে চিনেছে তাদের ব্যাপারে আল্লাহ বলেন,
وَمَن يَتَّقِ ٱللَّهَ يَجْعَل لَّهُۥ (مَخْرَجًا ُ وَيَرْزُقْهُ مِنْ حَيْثُ لَا يَحْتَسِبُ ُ
অর্থ: ২. যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে, তাকে তিনি তার মুক্তির জন্য পথ করে দেবেন, ৩. এবং তার জীবিকার এমন উপায় করে দেন, যা সে কল্পনাও করতে পারে না। (সূরা তালাক, আয়াত-২,৩)
মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেছেন,
يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓا۟ إِن تَتَّقُوا۟ ٱللَّهَ يَجْعَل لَّكُمْ فُرْقَانًا وَيُكَفِّرْ عَنكُمْ سَيِّـَٔاتِكُمْ وَيَغْفِرْ لَكُمْ وَٱللَّهُ ذُو ٱلْفَضْلِ ٱلْعَظِيمِ ُ
অর্থ: হে ঈমানদারগণ! যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় কর তবে আল্লাহ তোমাদের ফুরকান (সত্য মিথ্যা পার্থক্য করার জ্ঞান বা ক্বলবী জ্ঞান) দেবেন আর তোমাদের পাপসমূহ মোচন (ক্বলবকে পরিষ্কার) করবেন ও তোমাদের ক্ষমা করবেন; আর আল্লাহ অতিশয় করুণাময়। (সূরা আনফাল, আয়াত-২৯)। আল্লাহকে দেখা এবং চেনার জন্য মানুষের বাম স্তনের দুই আঙ্গুল নিচে একটি ছোট মাংসপিন্ড আছে, যাকে ক্বলব বলে। এ ক্বলব দিয়েই অদৃশ্য বিষয় দেখা যায়। মহান আল্লাহ বলেছেন,
أَفَلَمْ يَسِيرُوا۟ فِى ٱلْأَرْضِ فَتَكُونَ لَهُمْ قُلُوبٌ يَعْقِلُونَ بِهَآ أَوْ ءَاذَانٌ يَسْمَعُونَ بِهَا فَإِنَّهَا لَا تَعْمَى ٱلْأَبْصَٰرُ وَلَٰكِن تَعْمَى ٱلْقُلُوبُ ٱلَّتِى فِى ٱلصُّدُورِ ُ
অর্থ: তবে কি তারা ভূপৃষ্ঠে ভ্রমন করেনি? যদি তাদের ক্বলব থাকতো তা দিয়ে তারা জ্ঞান লাভ করতো, যদি তাদের কান থাকতো তা দিয়ে তারা শুনতো। আসলে ব্যাপার এ যে, তাদের চোখ অন্ধ হয়নি বরং তাদের বুকের মধ্যকার ক্বলবই অন্ধ হয়ে গেছে। (সূরা হজ, আয়াত-৪৬)
মহান আল্লাহ আরো বলেছেন,
قَدْ جَآءَكُم بَصَآئِرُ مِن رَّبِّكُمْ فَمَنْ أَبْصَرَ فَلِنَفْسِهِۦ وَمَنْ عَمِىَ فَعَلَيْهَا وَمَآ أَنَا۠ عَلَيْكُم بِحَفِيظٍ ُ
অর্থ: তোমাদের নিকট চোখ (অন্তর বা ক্বলব) খুলে দেয় এমন প্রমাণাদি এসেছে তোমাদের রবের পক্ষ থেকে, সুতরাং যেই দেখেছে তা তার নিজেরই মঙ্গলার্থে দেখেছে (অর্থাৎ নিজেকে চিনেছে) এবং যে অন্ধ হয়েছে সে নিজেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে; এবং আমি তোমাদের রক্ষক নই। (সূরা আনআম, আয়াত-১০৪)
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (সাঃ) আল্লাহকে নিজের ক্বলব দ্বারা দেখেছেন। (মুসলিম, হাদিস নং-৩৩৩)
অর্থাৎ ক্বলব দ্বারা আল্লাহকে দেখা, চেনা, সম্পর্ক গড়ে ওঠা, সৃষ্টি রহস্যের জ্ঞান অর্জন করা, জিকির করা সবই এল্মে বেলায়েতের সাথে সম্পর্কিত। আর এ বেলায়েতের পূর্ণ জ্ঞান থাকে মহান আল্লাহর বন্ধুদের কাছে অর্থাৎ অলি-আল্লাহদের কাছে যাদের কাছে তরিকা গ্রহণ করলে বা বায়আত হলে একজন সাধারণ মানুষ হেদায়েতের মাধ্যমে মুমিন মুসলমান হয়ে অসাধারণ হতে পারে।
হাদিসে কুদসীতে এসেছে-
ان الله تعالى قد خلق قبل الاشياء نور نبيك من نو ُ
অর্থ: নিশ্চয় আল্লাহ সমস্ত কিছুর পূর্বে নবীর নূর মুবারক তাঁরই (আল্লাহর) নূর মুবারক হতে সৃষ্টি করেছেন। (নাসরুত্তীব, আশরাফ আলী থানভী)
রাসুুলেপাক (সাঃ) ইরশাদ করেন,
أول ما خلق الله نورى ُ
অর্থ: আল্লাহ সর্বপ্রথম আমার নূর সৃষ্টি করেছেন। এ হাদিসটি হযরত যাবের (রাঃ) হতে বর্ণিত। (মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক, বায়হাকি, দালালেলুন নবুয়ত)
নবী করিম (সাঃ) ইরশাদ করেন,
المؤمن ينظر بنور الله تعلى عز وجل الذى خلق منه ُ
অর্থ: মুুমিন বান্দাগণ আল্লাহর নূর দ্বারা দেখে যে নূর দ্বারা তাঁর সৃষ্টি করা হয়েছে। (আল ফিরদাউস, ঈমাম দায়লামী-৪/১৭৮, হাদিস-৬৫৫৪; কাশফুল খাফা, ঈমাম আযলুনী-২/৩৯৬, হাদিস-২৭০০) এ হাদিসটি আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত।
ঈমাম গাজ্জালী (রঃ) তাঁর “দাকায়েকুল আখবার” কিতাবে এভাবে লিখেছেন, “আল্লাহতায়ালা স্বীয় নূর হতে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) কে সর্বপ্রথম সৃষ্টি করেন। পরবর্তীতে নূরে মুহাম্মদী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম হতে সমস্ত জগৎ এবং জগৎ এর সবকিছু সৃষ্টি করা হয়”। এজন্যই সারা জগৎ এ নূর বিদ্যমান আর ক্বলবের নূরের চোখ দিয়েই মুমিনগণ দেখেন।
রাসুলেপাক (সাঃ) ইরশাদ করেছেন,
الْمُؤْمِنُ أَعْظَمُ حُرْمَة مِنَ الْكَعْبَةِ ُ
অর্থ: মুমিন ব্যক্তি কাবা শরীফ হতেও অধিক সম্মানী। (ইবনে মাজাহ)
নবী করিম (সাঃ) ইরশাদ করেন,
قَلْبُ الْمُؤْمِنِ عَرْشُ اللهِ ُ
অর্থ: মুমিন বান্দার ক্বলব হলো আল্লাহর আরশ। (ঈমাম সাখাভী, মাকাসিদুল হাসানা, পৃষ্ঠা-৪২৯, হাদিস-৯৮৮; আজলুনী, কাশফুর খাফা, পৃষ্ঠা-২/১৯৫, হাদিস-২২৫৪)
রাসুলেপাক (সাঃ) ইরশাদ করেন, “যমীনবাসী থেকে অবস্থানের পাত্র রয়েছে তোমাদের প্রভুর, সেই অবস্থানের পাত্র হলো মুমিনের ক্বলব”। এ হাদিসটি হযরত আবি ইনাবাতাল খোলানী (রাঃ) হতে বর্ণিত। (তাবরানী, মুসনাদে সামীন, পৃষ্ঠা-২/১৯, হাদিস-৮৪০; জালালুদ্দিন সুয়ূতী, জামেউস সগীর, পৃষ্ঠা-১/৩৬৪, হাদিস-২৩৭৫ ও জামিউল আহাদিস, পৃষ্ঠা-৯/১৯৬, হাদিস-৮২৩৩; সাখাভী, মাকাসিদুল হাসানা, পৃষ্ঠা-৩৮০, হাদিস-৯৯০; শায়খ ইউসুফ নাবহানী, ফতহুল কাবীর, পৃষ্ঠা-১/৩৭৭, হাদিস-৪০৯১)
উপরোক্ত হাদিসদ্বয়ের সমর্থনে চার মাযহাব এর অন্যতম ঈমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রঃ) লিখেছেন, হযরত ওহহাব ইবনে মুনাব্বাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নিশ্চয় মহান আল্লাহতায়ালা আসমানসমূহকে খুলে দিয়েছেন হিযকিল নামক এক ফেরেশতার জন্য। তিনি আরশ পর্যন্ত দেখতে পেলেন এবং বললেন, আল্লাহ তুমি পাক-পবিত্র, তোমার শান মহান। অতঃপর মহান আল্লাহতায়ালা বললেন, নিশ্চয়ই আসমানসমূহ ও আরশ দূর্বলতা প্রকাশ করছে আমাকে স্থান দিতে কিন্তু মুমিনের ক্বলব বা অন্তর নম্রতা প্রকাশ করে আমাকে গ্রহণ করেছে। (ঈমাম ইবনে হাম্বল, কিতাবুল যুহুদ, পৃষ্ঠা-১/৬৯, দারুল কুতুব ইলমিয়্যাহ, বৈরুত, লেবানন; সাখাভী, মাকাসিদুল হাসানা, পৃষ্ঠা-৪২৯, হাদিস-৯৮৮; মোল্লা আলী ক্বারী, আসারুল মারফুআ ফি আখবারিল মাত্তদ্বুআত, পৃষ্ঠা-৩১০; মানাভী, ফয়যুল কাদীর, পৃষ্ঠা-১/২৮২; ইবনুল ইরাক, তানযিহুল শরিয়াহ, পৃষ্ঠা-১/১৪৮)
হাদিস শরীফে এসেছে-
سئل عن رسول الله (ص) ين بيت الله قال رسول الله (ص) فى قلوب المؤمنين ُ
অর্থ: রাসুলেপাক (সাঃ) কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিলো, আল্লাহর বাসস্থান কোথায়? তিনি দয়া করে উত্তর দিলেন, মুমিনের ক্বলবের ভেতর। (হাকিকতে আউলিয়া)
হযরত জালালুদ্দিন রুমী (রঃ) বলেছেন, আসমান ও যমীন আমাকে (আল্লাহকে) ধারণ করতে পারে না, কিন্তু মুুমিনের ক্বলব আমাকে ধারণ করেছে। হযরত আব্দুল আজিজ দেহলভী (রঃ) তাফসিরে ফতহুল আজিজে সূরা ইনশিরাহ এর প্রথম আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেছেন, একজন মুমিন বান্দার ক্বলব বিশাল সমতল ময়দান। এই ময়দানের এক কোনায় একটি আবাসস্থল আছে। সেই আবাসস্থলের মধ্যে বারোটি কামরা আছে। প্রতিটি কামরা দশটি পৃথিবীর সমান এবং বারোতম কামরাটিতে স্বয়ং মাবুদের বসবাস।
রাসুলেপাক (সাঃ) ইরশাদ করেছেন,
لاصلوة الا بحضور القلب ُ
অর্থ: হুজুরী ক্বলব ছাড়া নামায হয়না। (হাকিকতে আউলিয়া)
হুজুরী ক্বলব হলো সেই ক্বলব যে ক্বলব মহান আল্লাহর প্রেমে নমনীয় ও নতজানু হয়ে হরদম জিকিররত থাকে। বর্তমানে নক্শবন্দি মোজাদ্দেদিয়া তরিকার কামেলে মোকাম্মেল আউলিয়ার খেদমত দ্বারা হুজুরী ক্বলব অর্জন করতে হবে, যেভাবে রাসুলেপাক (সাঃ)-এর জামানায় সাহাবী (রাঃ) গণ ঈমান আনার বায়আত গ্রহণ করে রাসুল (সাঃ)-এর খেদমত ও মহব্বতের দ্বারা রাসুল (সাঃ)-এর সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যমে ক্বলবের মধ্যে সদাসর্বদা রাসুল (সাঃ) জ্যোতির্ময় উপস্থিতি তথা জিকির জারি হতো। এজন্য রাসুলেপাক (সাঃ)-এর অনুপস্থিতিতে বর্তমানে তাঁর প্রতিনিধি বা ওয়ারিশ (নায়েবে নবী) জীবিত কামেলে মোকাম্মেল মুর্শিদ জামানার মোজাদ্দেদের কাছে বায়আত হতে হবে। হাদিস শরীফে এসেছে, অলিগণ নবীর ওয়ারিশ। (তিরমিজি, আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ)
হুজুরেপাক (সাঃ) ইরশাদ করেন,
فى الخبران العبد اذا اقام الصاوة رفع الله منه اليه وجهه بوجهه ُ
অর্থ: বান্দা নামাযে দাঁড়িয়ে গেলে আল্লাহ নিজের ও তার মধ্যকার সকল পর্দা সরিয়ে ফেলেন এবং তাকে নিজের সামনে নিয়ে আসেন। (এহইয়াউ উলূমিদ্দীন- ১ম খন্ড)। এজন্যই রাসুল (সাঃ) বলেছেন, নামায মুুমিনের জন্য মেরাজ স্বরূপ। (তাফসীরে হাক্কী, ৮ম খন্ড, ৪৫৩ পৃষ্ঠা)। হযরত আলী (আঃ) এ প্রসঙ্গে বলেছেন,
لم اعبدر بالم يراه ُ
অর্থ: আমি যাকে দেখি না, আমি তেমন প্রভুর ইবাদত করি না। (সিররুল আসরার)
একই ভাবে হযরত ওমর (রাঃ) বলেছেন,
راى قلبى ربى بنور ربى ُ
অর্থ: আল্লাহর নূরের দ্বারা আমার অন্তঃকরণ (ক্বলব) আল্লাহর দর্শন লাভ করেছে। (সিররুল আসরার)। এজন্যই নামাযে বান্দা যখন মহান আল্লাহর ধ্যানে মশগুল থাকে তখন আল্লাহতায়ালার সাথে বান্দার দর্শন হয়।
রাসুলেপাক (সাঃ) বলেছেন,
وَجُعِلَتْ قُرَّةُ عَيْنِىْ فِىْ الصَّلاةِ ُ
অর্থ: সালাত তথা নামাযে আমার চক্ষু শীতল হয়। (নাসাই শরীফ, কিতাবু আশরাতিন নিসা, বাব: হব্বিন নিসা)
নবী করিম (সাঃ) এ প্রসঙ্গে আরো বলেছেন,
تَنَامُ عَيْنِيْ وَلَا يَنَامُ قَلْبِيْ ُ
অর্থ: আমার চোখ নিদ্রিত হলেও অন্তঃকরণ (ক্বলব) জাগ্রত (আল্লাহর জিকিরে) থাকে। (বুখারি, কিতাবুল মানাকেব ও কিতাবুত তারাবীহ)
জামানার মোজাদ্দেদের কাছে যখন একজন বান্দা বায়আত হবে তখন তার ক্বলবে জিকির জারী হবে। জিকির জারী হলে ক্বলব পাক-সাফ হতে থাকবে এবং সেখানে মহান আল্লাহর প্রেম-মহব্বত তৈরি হতে থাকবে।
রাসুলে পাক (সাঃ) ইরশাদ করেছেন,
لكل شيئ ثقالة وثقالة القلوب ذكر الله ُ
অর্থ: প্রতিটি বস্তু পরিষ্কার করার উপায় রয়েছে আর ক্বলবকে পরিষ্কার করার উপায় হলো আল্লাহর জিকির। (হাকিকতে আউলিয়া)
আল্লাহর প্রেমের গুরুত্ব প্রকাশ করে রাসুলেপাক (সাঃ) বলেছেন,
من لاوجدله لا حيواة له ُ
অর্থ: যার খোদা প্রেম নেই, তার জীবন নেই অর্থাৎ সে মৃত। (সিররুল আসরার)। এখানে ক্বলবে আল্লাহর মহব্বতের কথা বোঝানো হয়েছে।
রাসুলেপাক (সাঃ) খোদা প্রেম নিয়ে আরো বলেছেন,
من لاوجدله لا دين له ُ
অর্থ: যার খোদা প্রেম নেই, তার কোন ধর্ম নেই। (সিররুল আসরার)
এখন সুনির্দিষ্ট করে বলা যায় যে, জীবরাইল (আঃ) কর্তৃক বর্ণিত “এহ্সান” এর ইবাদতের জন্য প্রথম দরকার রাসুলেপাক (সাঃ)-এর খাস প্রতিনিধি (অলি-আল্লাহ) এর কাছে ঈমান আনার বায়আত গ্রহণ, যা ক্বলবে আল্লাহ ও রাসুল (সাঃ)-এর জ্যোতির্ময় নূরের প্রেমময় জিকির জারী করে দেবে সর্বপ্রথম একজন সত্যপথ অন্বেষাকারীর। এরপর সেই মুরিদ যদি পীরের খেদমতে নিজেকে আত্মনিয়োগ করতে পারে পরিপূর্ণভাবে তবে দিনে দিনে তার ক্বলব পরিষ্কার হবে এবং অবশ্যই তার আল্লাহ ও রাসুল (সাঃ)-এর দীদার লাভ হবে।
এ কথার সত্যতা কতখানি তা দেখা যাক। যখন রাসুলেপাক (সাঃ) মেরাজে গমন করলেন এবং আল্লাহর সাথে স্বশরীরে কথোপকথন হলো, তখন রাসুলেপাক (সাঃ) মহান আল্লাহকে আরয করলেন, “হে আল্লাহ! আপনার সাথে আমার মেরাজ হলো কিন্তু আমার উম্মতগণ কি আপনাকে দেখতে পাবে না”? তখন দয়াময় আল্লাহ বললেন, “হ্যাঁ, আপনার উম্মতের সাথে আমার মেরাজ (সাক্ষাত) হবে সালাতের মাধ্যমে”।
রাসুলেপাক (সাঃ) বলেছেন,
أَيُّهَا النَّاسُ اِنَّ الْمُصَلِّىْ إِذَا صَلِّى فَإِنَّهُ يُنَاجِىْ رَبَّهُ تَبَارَكَ وَتَعَالى، فَلْيَعْلَمْ بِمَا يُنَاجِيْهِ وَلَا يَجْهَرْ بَعْضُكُمْ عَلى بَعْضٍ ُ
অর্থ: হে বান্দাগণ! মুসল্লী যখন সালাত আদায় করে, সে নিশ্চয় তার রবের সাথে কথাবার্তায় লিপ্ত থাকে। সুতরাং সে তার রবের সাথে কি বলছে তা যেন খেয়াল রাখে এবং তোমাদের একে অপরের স্বরকে উঁচু না করে। (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস-৬১৩২)
অপর একটি হাদিসে রাসুলেপাক (সাঃ) ইরশাদ করেছেন,
إذَا قَامَ أَحَدُكُمْ إلِٰى الصَّلَاةِ، فَلَا يَبْصُقْ أمَامَهُ، فَإنَّمَا يُنَاجِي اللهَ مَا دَامَ فِيْ مُصَلَّاهُ ُ
অর্থ: যখন তোমাদের কেউ সালাতে দাঁড়ায় সে যেন সামনের দিকে থুথু না ফেলে। কেননা সে আল্লাহর সাথে গোপনে কথাবার্তায় মশগুল থাকে, যতক্ষণ সে নিজ সালাতের মুছল্লায় আছে। (বুখারি, হাদিস-৪০৫; মুসলিম, হাদিস-১১১০; মেশকাত, হাদিস-৬৫৮)
হযরত উকবা ইবনে আমের (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন- রাসুল (সাঃ) বলেছেন,
عَنْ عُقْبَةَ بْنِ عَامِرْ رَضِي اللهُ عَنْه ُقَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَا مِنْ مُسْلِمُ يَتَوْضَّأ فَيُحْسِنَ وَضُوْءَه، ثُمَّ يَقَوْمُ فَيُصَلِّيْ ركعتين، مُقبِلٌ عليهما بقلبه ووجهه، إلا وجَبَتْ له الجَنَّة رواء مسلم، مشكوة ُ
অর্থ: যদি কোন মুসলিম সুন্দরভাবে ওযু করে তারপর দাঁড়িয়ে দু’রাকাত সালাত এমনভাবে পড়ে যে, ঐ সালাতে তার ক্বলব ও মুখ (আল্লাহর দিকে) স্থির থাকে তাহলে জান্নাত তার জন্য ওয়াজিব হয়ে যায়। (মুসলিম, হাদিস-৪৪৪; মেশকাত, হাদিস-২৬৮)
এ প্রসঙ্গে রাসুল (সাঃ) আরো বলেছেন,
قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَا يَقْبَلُ اللهُ مِنْ عَبْدِ عَمَلًا حَتّٰ يُشْهِدُ قَلْبُهُ مَعَ يَدنِه ُ
অর্থ: আল্লাহতায়ালা বান্দার কোন আমল কবুল করেন না, যতক্ষণ বান্দার শরীরসহ তার ক্বলব ঐ আমলের সাক্ষ্য না দেয়। (আততারগীব ই: ফা: বা: ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা-৩৫৬)
যখন কেউ নামাযে দাঁড়ায়, তখন সে জায়নামাযে দাঁড়িয়ে প্রথমে পড়ে, “আমি একনিষ্ঠ ভাবে সেই আল্লাহর দিকে মুখ ফিরাচ্ছি যিনি আসমান ও যমীন সৃষ্টি করেছেন এবং আমি মুশরিকদের অন্তর্ভূক্ত নই”। এ দোয়া পড়ার মাধ্যমে ঐ বান্দা আল্লাহ থেকে অন্য দিকে মুখ ফেরাবে না বলে প্রতিশ্রæতিবদ্ধ হয়। যখন কেউ আল্লাহু আকবর বলে তাকবীরে তাহরিমা বাঁধে তখন আল্লাহ ব্যতীত অন্য কিছুর প্রতি খেয়াল বা চিন্তা করা তার জন্য হারাম হয়ে যায়। নামাযের মধ্যে আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন খেয়াল মনে আসলে সে সব খেয়ালকৃত ব্যক্তি বা বস্তুই হলো গায়রুল্লাহ। এ গায়রুল্লাহর খেয়ালে নামায পড়াকে শিরক বলে। এটা শিরকে খফি বা গোপন শিরক। এভাবে আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছুর খেয়াল করাই হলো শিরক। এছাড়া লোক দেখানো ইবাদত করাও শিরক। শিরককারীকে আল্লাহ ক্ষমা করবেন না। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন,
إِنَّ ٱلشِّرْكَ لَظُلْمٌ عَظِيمٌ ُ
অর্থ: শিরক হলো আমার প্রতি সর্বাপেক্ষা বড় জুলুম বা অবিচার। (সূরা লোকমান, আয়াত-১৩)
মহান আল্লাহ বলেন,
لَئِنْ أَشْرَكْتَ لَيَحْبَطَنَّ عَمَلُكَ وَلَتَكُونَنَّ مِنَ ٱلْخَٰسِرِينَ ُ
অর্থ: যদি তুমি (আল্লাহর সাথে) শিরক করো তবে নিশ্চয় তোমার সমস্ত আমল ধ্বংস হয়ে যাবে। আর তুমি অন্তর্ভূক্ত হয়ে যাবে ক্ষতিগ্রস্তদের। (সূরা আয যুমার, আয়াত-৬৫)
যখন কোন ব্যক্তি তাকবীরে তাহরিমা বেঁধে ফেলে তখন মহান আল্লাহপাক তার সামনে হাজির হন। এ সম্পর্কে একটি হাদিস উল্লেখ করা হলো-
رُوِىِّ عَنْ جَابِرٍ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اِذَاقَامَ الرَّجُلُ فِى الصَّلَاةِ أَقْبَلَ اللهُ عَلَيْهِ بِوَجْهِهِ، فَإِذَا اِلْتَفْتَ قَالَ : يَا اِبْنَ اَدَمَ إِلَى مَنْ تَلْتَفِتْ؟ إِلَى مَنْ هُوَ خَيْرُ لَّكَ مِنِّى، أَقْبِلُ اِلَىَّ، فَإِذَا الْتَفْتَ الثَّانِيَةَ قَالَ مِثْلَ ذَالِكَ، فَإِذَا التَفْتَ الثَّالِثَةُ صَرَفَ اللهُ ثَمَارَكَ وَتَعَالٰى وَجْهَهُ عَنْهُ ُ
অর্থ: হযরত জাবের (রাঃ) হতে বর্ণিত রাসুল (সাঃ) বলেন, “যখন কেউ সালাতে দাঁড়ায় তখন আল্লাহতায়ালা নিজ চেহারাকে তার দিকে ফেরান। যখন সে এদিক সেদিক খেয়াল করে তখন আল্লাহ বলেন, হে আদম সন্তান! তুমি কোন দিকে খেয়াল করছো? তুমি যাকে খেয়াল করছো সে কি আমার থেকে ভালো? তুমি আমার দিকে খেয়াল কর। যদি সে দ্বিতীয়বার এদিক সেদিক খেয়াল করে তখন আল্লাহতায়ালা আবার অনুরূপ বলেন। যদি সে তৃতীয়বার অন্যদিকে খেয়াল করে তখন আল্লাহ তার দিক থেকে নিজ চেহারা ফিরিয়ে নেন”। (আততারগীব ই:ফা:বা: ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা-৩৬৫, হাদিস-৫)। হাদিসে কুদসীতে আল্লাহ বলেন, “ছুঁড়ে মার ঐ নামাযীর নামায, যার চেহারাটা থাকে আমার দিকে এবং মনটা থাকে দুনিয়ার দিকে”। তখন ফেরেশতারা আল্লাহর আদেশে ঐ ব্যক্তির নামায ছেঁড়া কালো কাপড়ের পুটলির আকৃতিতে তার মুখে নিক্ষেপ করে (তিবরানী, আততারগীব ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা-২৫৮)। এমতাবস্থায় তার ইবাদত ধ্বংস হয়ে যায় এবং সে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভূক্ত হয়ে পড়ে।
কারো নামায কবুল হচ্ছে কিনা তা নামাযী ব্যক্তি নিজেই বুঝতে পারেন। নামাযে আল্লাহ ছাড়া অন্য দিকে খেয়াল চলে গেলে নামায কবুল হয়না মর্মে হাদিসে স্পষ্টভাবে উপরে উল্লেখ করা হয়েছে। যদি নামায হাদিস অনুযায়ী হয় তবে নামাযী বুঝতে পারে। নামাযে দাঁড়িয়ে অত্যন্ত মনোসংযোগ করা সত্তে¡ও মন বা ক্বলব অন্য খেয়ালে চলে যায়। কেন এরকম হয় সে সম্পর্কে রাসুলেপাক (সাঃ) বলেছেন,
الشَّيْطَاهُ حَاثِمُ عَلَى قَلْبِ ابْنِ اَدَمَ فَإِذَا ذَكَرَ اللهُ خَمْسَ وَإِذَا غَفَلَ وَسْوَسَ ـ (رواه البخارى تعلبقا) ُ
অর্থ: শয়তান আদম সন্তানদের ক্বলবে ঘাঁটি করে বসে আছে, যখন তা জিকির করে তখন সে পলায়ন করে এবং যখন ক্বলব জিকির থেকে গাফেল থাকে তখন সে অছওয়াছা দেয়। (মেশকাত, হাদিস-৭১৭৪)
প্রসঙ্গক্রমে হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত একটি হাদিস, রাসুলেপাক (সাঃ) বলেছেন,
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: إِذَا نُوْدِيَ لِلصَّلَاةِ أَدْبَرَ الشَّيْطَانُ لَهُ ضُرَاطٌ فَإِذَا قُضِيَ أَقْبَلَ إِذَا ثُوِّبَ بِهَا أَدْبَرَ. فَإِذَا قُضِيَ أَقْبَلَ حَتَّى يَخْطِرَ بَيْنَ الْاِنْسَانِ وَقَلْبِهِ فَيَقُوْلُ اُذْكُرْ كَذَا وَاذْكُرْ حَتّٰى لَايَدْرِىْ ثَلَاثَا صَلَّى اَمْ اَرْبَعَا فَاِذَا لَمْ يَدْرِا ثَلَاثَا صَلَّى اَمْ اَرْبَعَا سَحَدَ سَحْدَنِىْ السُّحْوِ ـ (رواه البخارى) ُ
অর্থ: যখন নামাযের আযান হয় তখন শয়তান বায়ু ছাড়তে ছাড়তে দূরে চলে যায়। আযান শেষ হলে সে ফিরে আসে। যখন ইকামত দেয়া হয়, তখন সে আবার দূরে সরে যায়। ইকামত শেষ হবার পর সে আবার ফিরে আসে। এরপর মানুষের নফস এবং তার ক্বলবের মধ্যে কুমন্ত্রণা ঢুকিয়ে দেয় ও নামাযে বাঁধা সৃষ্টি করে। শয়তান বলে- একথা মনে কর ঐ কথা মনে কর। ফলে নামাযরত ব্যক্তি তিন রাকাত পড়েছে না চার রাকাত পড়েছে, তা মনে করতে পারে না। যখন সে তিন রাকাত পড়েছে না চার রাকাত পড়েছে মনে করতে না পারে তখন সে যেন সিজদাহে সুহু অর্থাৎ ভুলের সিজদা দেয়। (বুখারি, হাদিস-৩০৫৫)
ক্বলব জিকির না করলে শয়তান কুমন্ত্রণা দিতে থাকে। এ প্রসঙ্গে নিম্মোক্ত হাদিসটি উল্লেখযোগ্য-
وَعَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ شَقِيْقِ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ : قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَا مِنْ اَدَمِيْ إِلَّا لِقَلْبِهِ بَيْتَانِ فِيْ أَحَدِهِمَا الْمَلْكُ وَفِيْ الْاٰخَرِ الشَّيْطَانُ ، فَإِذَا ذَكْرَ اللهُ خَنْسَ ، وَإِذَا لَمْ يَذْكُرِ اللهُ وَضَعَ الشَّيْطَانُ مِنْقَارَهُ فِيْ قَلْبِهِ فَوْسُوْسَ لَهُ ُ
অর্থ: হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে শাক্বিক (রাঃ) হতে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসুল (সাঃ) বলেছেন, আদম সন্তানের ক্বলব বা মনের মধ্যে দুটি কুঠরি আছে। একটিতে ফেরেশতা এবং অন্যটিতে শয়তান অবস্থান করে। যদি ক্বলব আল্লাহর জিকির করে তাহলে শয়তান সেখান থেকে পালিয়ে যায়। আর যদি ক্বলব জিকির না করে, শয়তান তার ঠোঁট ক্বলবের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে অছওয়াছা বা কুমন্ত্রণা দিতে থাকে। ইবনে শাবি শায়বা (রাঃ) এ হাদিসটি বর্ণনা করেছেন। (তাফছিরে মাজহারী ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা-১৫১)
এ ধরনের অবস্থায় পড়া ব্যক্তি তখন ভাল চিন্তা ও কাজ করতে পারে না। ফলে সে পাপাচারে লিপ্ত হয়ে পড়ে এবং ক্বলবের মধ্যে মরিচা ও কালো দাগ পড়ে পড়ে এক সময় ক্বলবের মুখ বন্ধ হয়ে যায়। এল্মে মারেফত হাসিল করে ক্বলবী জিকিরের মাধ্যমে এ মরিচা ও কালো দাগ দূর করা সম্ভব। আর ক্বলবী জিকিরের প্রতিদান সত্তর গুণ বেশী। এ প্রসঙ্গে একটি হাদিস উল্লেখযোগ্য-
عَنْ عَائِشَةَ رَضِىَ اللهُ عَنْهَا قَالَتْ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَفَصْلُ الذَّكْرِ الْخَفِىْ الَّذِىْ لَايَسْمَعُهُ الْحَفْظَةُ سَبْعُوْنَ صِعْقًا ُ
অর্থ: হযরত আবু ইয়াশা (রাঃ) হযরত আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন- রাসুল (সাঃ) বলেছেন, যে গোপন জিকিরের শব্দ কিরামান-কাতেবিন অর্থাৎ আমলনামা লেখক ফেরেশতাগণ শুনতে পাননা, তার নেকী সত্তর গুণ বেশী। (মেরকাত ৫ম খন্ড, পৃষ্ঠা-৪৯)
ক্বলবে মরিচা ধরে তখনই যখন ক্বলবের রোগ হয়। আর ক্বলবের রোগ হলো মানুষ যখন কথা-কাজের দ্বারা বা পঞ্চইন্দ্রিয় দ্বারা কোন পাপ বা অন্যায় করে তখন ক্বলবের উপর কালো দাগ পড়ে। এ প্রসঙ্গে রাসুলেপাক (সাঃ) ইরশাদ করেন,
عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إنَّ الْمُؤْمِنَ إِذَا أذْنَبَ ذَنْبًا كَانَتْ نُكْتَةٌ سَوْدَاءُ فِي قَلْبِهِ فَإِنَّ تَابَ وَاسْتَغْفَرَ صُقِلَ قَلْبَهُ وَإِنْ زَادَ زَادَتْ حَتّٰى تَعْلُو قَلْبَهُ، فَذَلِكُمُ الرَّانُ الَّذي ذَكَرَ اللهُ تَعَالَى كَلَّا بَلْ رَانَ عَلَى قُلُوبِهِمْ مَا كَانُوا يَكْسِبُونَ ـ (رواه٨ احمد والترمذى وابن ماجه وقال الترمذى هذا حديث حسن صحيح، كذا فى المشكوة) ُ
অর্থ: মুমিন যখন কোন গুনাহ করে তখন তার ক্বলবের উপর একটি কালো দাগ পড়ে। এর পর সে যদি তওবার মাধ্যমে অনুতাপ-অনুশোচনা করে ও মুখ দিয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চায়, তাহলে তার ক্বলবকে পরিষ্কার করে দেয়া হয়। আর গোনাহ বেশী করলে কালো দাগও বেশী হয়। এমনকি তার ক্বলবকে কালো দাগে ঢেকে ফেলে। রাসুল (সাঃ) বলেন, এ হলো সেই মরিচা, যে সম্পর্কে মহান আল্লাহ কুরআন মজিদে ইরশাদ করেছেন, “কখনোই না, বরং তারা যে সব বদ আমল করেছে তার ফলে তাদের ক্বলবে মরিচা পড়েছে”। (তিরমিজি, ইবনে মাজাহ, আহমাদ, মেশকাত, হাদিস-২২৩৩)
এই বিষয়ে রাসুলেপাক (সাঃ) এর আরো একটি হাদিস উল্লেখযোগ্য –
قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اِنَّ هذِهِ الْقُلُوْبِ تَصْدَه كَمَا يَصْدَء الْحَدِيْدِ اِذَا اَصَابَهُ الْمَاءُ الخ ُ
অর্থ: নিশ্চয় সকল ক্বলবের মধ্যে (গোনাহ করার কারণে) মরিচা পড়ে, যেমনি ভাবে পানি লাগার কারণে লোহার গায়ে মরিচা ধরে। (বায়হাকি)
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত- রাসুলেপাক (সাঃ) বলেছেন,
اِنَّ اِبْنُ مَسْعُوْدِ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ لَا يَزْالُ الْعَبْدُ يَكْذِبُ وَيَتَحَرَّى الْكِذْبِ فِبُكْتُ فِىْ قَلْبُهُ نُكْتَهُ سَوْدَاءُ حَتّى يَسْوَدُ فَلْمُهُ ـ (رواه مالك) ُ
অর্থ: যখন কোন বান্দা সব সময় মিথ্যা বলে থাকে এবং জেনে বুঝেই এ মিথ্যা বলে, তখন তার ক্বলবের মধ্যে কালো দাগ পড়ে যায়। এমনকি কালো দাগ পড়তে পড়তে তার সমস্ত ক্বলব কালো দাগে ঢেকে যায়। (মুয়াত্তা ঈমাম মালিক, হাদিস-১৮, পৃষ্ঠা-৭৫৫)হযরত ওমর (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসুলেপাক (সাঃ) বলেছেন,
عَنِ ابْنِ عُمْرَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رسُولُ اللهِ ﷺ تُكْثِرُوْا الْكَلَامَ بِغَيْرِ ذِكْرِ اللهِ فَإنَّ كَثْرَةَ الْكَلَامِ بِغَيْرِ ذِكْرِ اللهِ قَسْوَةٌ لِلْقَلْبِ وَإنَّ أَبْعَدَ النَّاسِ مِنَ اللهِ الْقَلْبُ الْقَاسِيْ ُ : لَا
অর্থ: তোমরা আল্লাহর জিকির ছাড়া বেশী কথা বলো না। কেননা জিকির ব্যতীত বেশী কথা বললে ক্বলব শক্ত হয়ে যায়। আর মানুষের মধ্যে শক্ত ক্বলবওয়ালা ব্যক্তি আল্লাহ হতে বেশী দূরে সরে যায়। (তিরমিজি)
রাসুলেপাক (সাঃ) আরো ইরশাদ করেছেন,
قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَاتَكْثُرُ الضَّحْكَ فَاِنَّ كَثْرَةُ الصِّخْكِ تُمِيْتُ الْقَلْبِ ـ (رواه ابن ماجه والترمذى) ُ
অর্থ: তোমরা বেশী বেশী হেসো না, কারণ বেশী হাসা ক্বলবকে মেরে ফেলে। (ইবনে মাজাহ, তিরমিজি)
পবিত্র কুরআন মজিদে মহান আল্লাহ বলেছেন,
خَتَمَ ٱللَّهُ عَلَىٰ قُلُوبِهِمْ وَعَلَىٰ سَمْعِهِمْ وَعَلَىٰٓ أَبْصَٰرِهِمْ غِشَٰوَةٌ وَلَهُمْ عَذَابٌ عَظِيمٌ ُ
অর্থ: আল্লাহ তাদের ক্বলব ও কান মোহর করে দিয়েছেন। আর তাদের চোখের উপর কালো ঠুলী (আবরণ) রয়েছে এবং তাদের জন্য রয়েছে মহাশাস্তি। (সূরা বাকারা, আয়াত-৭)
মহান আল্লাহ আরো বলেছেন,
فِى قُلُوبِهِم مَّرَضٌ فَزَادَهُمُ ٱللَّهُ مَرَضًا وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌۢ بِمَا كَانُوا۟ يَكْذِبُونَ ُ
অর্থ: তাদের ক্বলবে ব্যাধি রয়েছে। অতঃপর আল্লাহ তাদের ব্যাধি আরো বৃদ্ধি করে দিয়েছেন (তারা বায়আতের মাধ্যমে তওবা করে ক্বলব পরিষ্কার না করায়)। এবং তাদের জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি, কারণ তারা মিথ্যাবাদী। (সূরা বাকারা, আয়াত-১০)
মিথ্যা কথা বলার জন্য ক্বলবের দুর্গন্ধের ব্যাপারে রাসুলেপাক (সাঃ) বলেছেন,
قَالَ : إِذَا كَذَبَ الْعَبْدُ تَبَاعَدَ عَنْهُ الْمَلَكُ مِيْلًا مِنْ نَتْنِ مَا جَاءَ بِهِ ُ
অর্থ: বান্দা যখন মিথ্যা কথা বলে ফেরেশতা তার নিকট থেকে দুর্গন্ধের কারণে এক মাইল দূরে চলে যায়। (আততারগীব ই:ফা:বা: ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা-৬২৫, হাদিস-৩০)
মহান আল্লাহ যখন সঠিক সুপারিশ প্রাপ্ত হন রাসুল (সাঃ) এবং অলি-আল্লাহদের মাধ্যমে কোন বান্দার হেদায়েতের জন্য তখন তিনি ঐ ক্বলবকে আল্লাহমুখী করে দেন। রাসুলেপাক (সাঃ) বলেছেন,
وَاِنَّمَا قُلُوْبَ الْعِبَادِ بَيْنَ اِصْبَعَى الرَّحْمٰنِ اَنَّهُ اِذَا اَرَادَ اَنْ يُّقْلَّبَ قَلْبَ عَبْدِ قَلْبَهُ ُ
অর্থ: নিশ্চয়ই বান্দাদের ক্বলবসমূহ আল্লাহর দু’আঙ্গুলের ফাঁকে আছে। যখন আল্লাহ কোন বান্দার ক্বলবকে পরিবর্তন করার ইচ্ছা করেন, তখন তিনি তার ক্বলবকে পরিবর্তন করে দেন। (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস-২৬১৮৮)
এ প্রসঙ্গে আরেকটি হাদিসে নবী করিম (সাঃ) ইরশাদ করেন,
لَيْسَ اَدْمِىُّ اِلَّا وَقَلْبَهُ بَيْنَ اَصْبَعَيْنِ مِنْ اَصَابِعَ اللهِ ُ
অর্থ: এমন কোন মানুষ নেই যার ক্বলব আল্লাহর দু’আঙ্গুলের ফাঁকে নেই। (তিরমিজি, দাওয়াত অধ্যায়, পৃষ্ঠা-৮৯)
রাসুলেপাক (সাঃ) আরো ইরশাদ করেছেন,
اِنَّ قُلُوْبَ بَنِىْ اَدَمَ كُلَّهَا بَيْنَ اِصْبَعَيْنِ مِنْ اَصَابِعَ الرَّحْمَانِ كَقَلْبٍ وَّاحِدٍ يُصَرِّفُهُ حَيْثُ يَشَاءُ ـ ثُمَّ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : اَللّهُمَّ مُصَرِّفَ الْقُلُوْبِ صَرِّفْ قُلُوْبَنَا عَلَى طَاعَتِكَ ُ
অর্থ: নিশ্চয় আদম সন্তানের সকল ক্বলব আল্লাহর আঙ্গুলগুলির দু’আঙ্গুলের মাঝখানে একটি ক্বলব হিসেবে আছে। আল্লাহ তাকে যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে ঘুরান। এরপর রাসুল (সাঃ) বলেন, হে ক্বলবসমূহের পরিবর্তনকারী! আমাদের ক্বলবকে তোমার অনুগত হবার জন্য পরিবর্তন করে দাও। (মুসলিম, হাদিস-৬৫০৯; মেশকাত, হাদিস-৮৩)
পরিশেষে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, আমাদের ক্বলবকে আল্লাহর অনুগত করতে পরিপূর্ণ ভাবে এল্মে শরীয়তের পাশাপাশি এল্মে মারেফত (ক্বলবী এল্ম) অর্জন করতে হবে। দুটো অর্জন করাই প্রত্যেক ঈমানদার ব্যক্তির জন্য ফরয। এজন্য হুজুরেপাক (সাঃ) বলেছেন,
لا يقبل الله تعالى عبادت العبد بغير معرفت الله تعالى ان كان الف سنة ُ
অর্থ: মারেফত না জানলে আল্লাহতায়ালা ইবাদত বন্দেগী কবুল করবেন না। যদি কেউ হাজার বছর ইবাদত করে তবুও মারেফত ব্যতীত কবুল হবে না। (হাকিকতে আউলিয়া)
এল্মে তাছওয়াফ বা মারেফত হলো আল্লাহতায়ালাকে চেনা ও জানার জ্ঞান। আল্লাহকে না চিনলে আত্মশুদ্ধি হবেনা। ইবাদতের উদ্দেশ্য হবে মহান আল্লাহকে চেনা ও জানার মধ্য দিয়ে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন। এ জন্য প্রথম কাজ হলো সিলসিলার কামেলে মোকাম্মেল আউলিয়ার কাছে ঈমান আনার বায়আত গ্রহণ করে ক্বলবকে শয়তানমুক্ত করা এবং যাবতীয় নফসানিয়াত হতে নিজেকে মুক্ত রাখা। এভাবে নিজেকে পরিশুদ্ধ করাকে আত্মশুদ্ধি বলে। মহান আল্লাহ বলেছেন,
يَوْمَ لَا يَنفَعُ مَالٌ وَلَا بَنُونَ ُ إِلَّا مَنْ أَتَى ٱللَّهَ بِقَلْبٍ سَلِيمٍ ُ
অর্থ: যেদিন (কেয়ামতের দিন) কোন অর্থ-সম্পদ এবং সন্তান-সন্ততি কারো কোন উপকারে আসবে না। সেদিন উপকৃত হবে কেবল সে-ই যে বিশুদ্ধ ক্বলব নিয়ে আল্লাহর কাছে উপস্থিত হবেন। (সূরা আশ-শুরা, আয়াত-৮৮,৮৯)
আর এই বিশুদ্ধ অন্তঃকরণ বা ক্বলব অর্জনের একমাত্র পথ নক্শবন্দি মোজাদ্দেদিয়া তরিকতের যিনি বর্তমান জামানার মোজাদ্দেদ তাঁর কাছে যেয়ে ঈমান আনার বায়আত গ্রহণ করা। বায়আত হয়ে পীরের খেদমত করলে আত্মশুদ্ধি হবে এবং ক্বলবে জিকির জারী থাকবে ইহকালে, কবরে এবং হাশরে। আর এভাবে যাদের ক্বলবে জিকির হয়ে থাকে তাদের জাকের বা আহলে জিকির বলে। এদের সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেছেন,
ٱلَّذِينَ يَذْكُرُونَ ٱللَّهَ قِيَٰمًا وَقُعُودًا وَعَلَىٰ جُنُوبِهِمْ وَيَتَفَكَّرُونَ فِى خَلْقِ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلْأَرْضِ رَبَّنَا مَا خَلَقْتَ هَٰذَا بَٰطِلًا سُبْحَٰنَكَ فَقِنَا عَذَابَ ٱلنَّارِ ُ
অর্থ: যারা দাঁড়ানো, বসা ও শোয়া সকল অবস্থায় আল্লাহর জিকির করে এবং আসমানসমূহ ও যমীনের সৃষ্টি রহস্য নিয়ে গভীর চিন্তা-ভাবনা করে আর (বলে), হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি নিরর্থক এ সৃষ্টি করনি। তুমি পবিত্র! তুমি আমাদেরকে দোযখের শাস্তি থেকে রক্ষা করো। (সূরা আল-ইমরান, আয়াত-১৯১)